পাখিদের জৈবিক কম্পাস

পাখিদের জৈবিক কম্পাস

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩০ নভেম্বর, ২০২৫

আচ্ছা, পাখিরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেও কিভাবে অনায়েসে নিজের ঠিকানায় সামান্যতমও দিকভ্রষ্ট না হয়েই ফিরে আসে? বহুকাল ধরে পাখিদের দিকনির্ণয়ের সুনিপুণ দক্ষতা নিয়ে চর্চা চলে আসছে। বিজ্ঞানীরাও তাদের এই আশ্চর্য ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করে আসছেন। বিশেষত পরিযায়ী পাখি বা পায়রার মতো প্রজাতি কীভাবে হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও সঠিক পথে ফিরে আসছে? এই সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে এক রহস্যময় ক্ষমতা। সে হল পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করার সামর্থ্য। বহু তত্ত্ব, বহু বিতর্ক পেরিয়ে এবার মনে হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা সম্ভবত সত্যিকারের দিকনির্দেশক কম্পাস অঙ্গটির সন্ধান পেয়েছেন। তাঁরা বলছেন এই বিশেষ ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে পায়রার অন্তঃকর্ণে। এখানকার ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক সংকেতের সাহায্যে তারা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে।অর্থাৎ এই ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক সংকেতই প্রকৃত পথনির্দেশের ভাষা ।

গবেষক দলটি উন্নত মস্তিষ্ক-মানচিত্রায়ণ পদ্ধতি এবং একক কোষের আর এন এ সিকোয়েন্সিং ব্যবহার করে পায়রার অন্তঃকর্ণের কোষ বিশ্লেষণ করেছে। উভয় পদ্ধতি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে পাখির চৌম্বক সংবেদ /ম্যাগনেটোরিসেপশনের দিকে, যা অন্তঃকর্ণভিত্তিক কোষের মাধ্যমেই পরিচালিত হতে পারে। এই ফলাফল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবেদন-বিজ্ঞানী এরিক ওয়ারান্ট বলেন, এটি এখন পর্যন্ত প্রাণীজগতে চৌম্বক অনুভবের স্নায়বিক পথ নির্ণয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। তবে বহু প্রাণীর ক্ষেত্রেই, বিশেষত কচ্ছপ, ট্রাউট বা রবিন মাছেদের চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভবের ধারণাও বহুবার উঠে এসেছে। যদিও তা নিয়ে বিতর্কও কম নয়।

পাখিরা কীভাবে চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করে—তা ব্যাখ্যা করতে দুটি তত্ত্ব বিশেষভাবে আলোচিত ছিল—

1. চোখের রেটিনায় কোয়ান্টাম-নির্ভর প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পাখিরা চৌম্বক ক্ষেত্র দেখতে পায়।

2. ঠোঁটে থাকা ক্ষুদ্র লৌহ-কণা ক্ষুদে কম্পাসের মতো কাজ করে।

তবে কোন স্নায়বিক পথে এই তথ্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করে, তা স্পষ্ট ছিল না।

 

২০১১ সালের কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত মেলে যে চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে পায়রার ভেস্টিবুলার সিস্টেম (যা শরীরের ত্বরণ ও ভারসাম্য শনাক্ত করে) সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। ফলে এই অঙ্গটিই দিক নির্দেশনার আসল কম্পাস হতে পারে বলে ধারণা জোরদার হয়।

সম্প্রতি স্নায়ুবিজ্ঞানী ডেভিড কেয়সের নেতৃত্বাধীন দল ছয়টি পায়রাকে পৃথিবীর তুলনায় শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা রাখে। তাদের মাথা স্থির রেখে চৌম্বক ক্ষেত্রটি ঘোরানো হয়, যেন মাথা নাড়ানোর মতোই প্রভাব সৃষ্টি হয়।পরে একটি বিশেষ জিনগত পদ্ধতিতে তাদের মস্তিষ্ক স্বচ্ছ করে নিউরন-সক্রিয়তার মানচিত্র তৈরি করা হয়।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে সক্রিয় হওয়া নিউরনগুলো ঠিক সেই অংশেই বেশি—যেখানে ভেস্টিবুলার সিস্টেমের সংকেত পৌঁছায়, এবং যেসব অংশ বহু সংবেদন সংকেতকে একত্রিত করে। এটিই স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে অন্তঃকর্ণই মূল চৌম্বক সংবেদন অঙ্গ। যদিও কোষগুলো কীভাবে সরাসরি চৌম্বকের প্রতিক্রিয়া বোঝে সেটা জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

বিষয়টি নেহাতই নতুন কোনো অনুমান নয়। ১৮৮২ সালে ফরাসি প্রাণীবিজ্ঞানী ক্যামিল ভিগিয়ে ধারণা দিয়েছিলেন যে চৌম্বক ক্ষেত্র জীবদেহে ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক স্রোত সৃষ্টি করতে পারে। হাঙ্গর ও স্কেট মাছের বৈদ্যুতিক সংবেদন ব্যবস্থাও এই নীতির ওপরই দাঁড়িয়ে। নতুন গবেষণা সেই শতাব্দী-পুরোনো ধারণারই বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি বলে মনে হয়।

 

তবে আরও গবেষণা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পাখিদের দিক খুঁজে পাওয়া কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নয় – এদের অন্তঃকর্নের বৈদ্যুতিক সংকেত-নির্ভর এক নিখুঁত জৈব-কম্পাসই তাদের পথ চিনে ফিরে আসার আসল অবলম্বন।

 

সূত্র : Has birds’ mysterious ‘compass’ organ been found at last? By Davide Castelvecchi, published in ‘nature’ journal, 20th November,2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 1 =