পাখির গান ও ডোপামিন

পাখির গান ও ডোপামিন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ মার্চ, ২০২৫

উত্তর ক্যারোলাইনার ডারহামের এক শান্ত অফিসঘরে বিজ্ঞানী রিচার্ড মিউনি বসে আছেন। তিনি জেব্রা ফিঞ্চ নামের এক ধরনের পাখির মস্তিষ্কের ছবি দেখছেন। প্রতিটি ছবিতে ফুটে উঠেছে এক তরুণ পাখির গান শেখার মুহূর্তে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট আলোক বিন্দুর মতো স্নায়ুর কার্যকলাপ, বা একাকী গানে রাসায়নিক পরিবর্তনের ঝলমলে রেখাচিত্র। ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রিচার্ড মিউনি ৪০ বছর ধরে গবেষণা করছেন কীভাবে পাখিরা গান শেখে। তাঁর মতে, ছোট ছোট ভুলভরা ডাক আসলে বড় কিছু শেখার শুরু। তিনি বলেন, শুরুতে তাদের গান খুব ভালো শোনায় না।কিন্তু ঠিক যেমন শিশুরা কথা বলতে শেখে বা কেউ হারমোনিয়াম বাজানো শেখে, তেমনই জেব্রা ফিঞ্চ পাখিদেরও অনেক অনুশীলন করতে হয়। এক মাস ধরে তারা দিনে প্রায় ১০,০০০ বার গান গেয়ে কসরত করে। এত অনুশীলনের পরই তারা সুন্দর ও জটিল সুর গাইতে পারে। রিচার্ড মিউনি ও ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন পিয়ারসনের নতুন গবেষণার ফলে এখন বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন, পাখিদের এত অনুশীলনের পেছনে কী কারণ এবং এ থেকে শেখার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কী জানা যায়।এই গবেষণাটি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, কিভাবে কেউ কোনো বাহ্যিক পুরস্কার ছাড়াই গান শিখতে পারে। এটি মানুষের চলাফেরা শেখার প্রক্রিয়া ও কিছু মস্তিষ্কজনিত সমস্যাকে বোঝার ক্ষেত্রেও সাহায্য করতে পারে। গবেষকরা একদল তরুণ পুরুষ গায়ক জেব্রা ফিঞ্চ পাখিকে শব্দনিরোধী ঘরে রেখেছিলেন যেখানে তারা ইচ্ছেমতো গান অনুশীলন করতে পারত।এই পাখিরা ছোটবেলায় তাদের বাবার গান শুনে তা মনে রাখে এবং এরপর ধীরে ধীরে সেই সুর গাইতে শেখে। এরপর, ঠিক যেমন শিশুরা কথা বলতে শেখার আগে অস্পষ্ট শব্দ করে, তেমনই এসব পাখি এলোমেলোভাবে ডাকতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তারা সেই ডাককে ঠিকঠাক গানের রূপ দেয়, যা তাদের মনে রাখা সুরের সঙ্গে মিলতে থাকে।এই শেখার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবার জন্য অধ্যাপক পিয়ারসনের দলটি এক বিশেষ কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করে। এটি পাখিদের হাজারো গান বিশ্লেষণ করে এবং নম্বর দিয়ে তাদের উন্নতি মাপতে পারে। এর ফলে গবেষকরা দেখতে পান প্রতিটি পাখির গান কীভাবে ধাপে ধাপে বদলাচ্ছে। গবেষক পিয়ারসন জানান এর মধ্যে কিছু গান একটু ভালো হয় আবার কিছু গান একটু খারাপ। কিন্তু সাধারণভাবে যত বেশি অনুশীলন করা হয় তত ভালো হয়। পাখিরা তাদের গান আরও ভালো করার সময় গবেষকরা তাদের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ বেসাল গ্যাংলিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। এই অংশটি নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।তারা এমন একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, যেখানে ডোপামিন নামে এক বিশেষ রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকলেই আলো জ্বলে ওঠে। ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কে আনন্দ ও অনুপ্রেরণা জাগায়।গবেষকরা বুঝতে পারেন , পাখিরা গান চর্চা করলেই ডোপামিন বেড়ে যায়, সে গান ভালো খারাপ যাই হোক।অর্থাৎ, সঠিক সুর লাগাতে পারুক বা না পারুক, শুধু চেষ্টা করলেই মস্তিষ্ক আনন্দের সংকেত দেয়। কোনো পাখি তার বয়স অনুযায়ী প্রত্যাশার চেয়ে ভালো গান গাইলে ডোপামিন আরও বেশি বেড়ে যায়। আর তার গান খারাপ হলে ডোপামিন একটু কমে যায়। এই পরিবর্তনগুলো থেকে বোঝা যায় পাখিদের মস্তিষ্ক বাইরের কোন সাহায্য ছাড়াই নিজেই ভালো গান গাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে ও ভুলগুলো সংশোধন করে । গবেষক মিউনি জানান পাখিটিকে কেউ কিছু না বলা সত্বেও তারা একা একা শব্দনিরোধী ঘরে বসে শুধু গান গেয়ে চলেছে।গবেষণায় দেখা গেছে ডোপামিন আসলে এক ধরনের ভিতরের দিকনির্দেশনা দেয়, যা পাখিদের নিজে নিজে উন্নতি করতে সাহায্য করে। কেন মানুষ বা প্রাণীরা কোনো পুরস্কার বা শাস্তি ছাড়াও শেখার প্রক্রিয়া জারি রাখতে পারে, তার ব্যাখ্যা মেলে এ থেকে। গবেষকরা দেখেছেন, অ্যাসিটাইলকোলিন নামের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক মনোযোগ ও শেখার কাজে সাহায্য করে।গবেষক কিউ বলেন পাখিরা গান গাওয়ার সময় অ্যাসিটাইলকোলিন তাদের ডোপামিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ও এটি তাদের শেখার আগ্রহ আরও বাড়ায়।কিন্তু বিজ্ঞানীরা ডোপামিন বা অ্যাসিটাইলকোলিন বন্ধ করে দিলে আশ্চর্যজনক পরিবর্তন দেখা যায় ও শেখার প্রক্রিয়া একেবারে থেমে যায়। এই গবেষণা জেব্রা ফিঞ্চ পাখির ওপর করা হলেও এর ফলাফল শুধু পাখিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পাখিরা শেখার সময় তাদের মস্তিষ্কের যে অংশ ও যেসব রাসায়নিক (যেমন বেসাল গ্যাংলিয়া, ডোপামিন, অ্যাসিটাইলকোলিন) কাজ করে, তা মানুষের মস্তিষ্কেও একইভাবে কাজ করে।মস্তিষ্কের এই প্রক্রিয়া কাজ করা বন্ধ করে দিলে কী হয় সেটা বোঝার ক্ষেত্রে এই গবেষণা সাহায্য করতে পারে। ডোপামিনের সমস্যা পারকিনসন ও স্কিজোফ্রেনিয়ার মতো রোগের কারণ হতে পারে।পাখিদের শেখার প্রক্রিয়া দেখে বিজ্ঞানীরা সহজভাবে এই বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। গবেষক পিয়ারসন বলেন, মস্তিষ্কের এইসব অংশগুলোকে বুঝতে পারা খুব দরকার এবং পাখিরা আমাদের তা সহজভাবে শেখার সুযোগ করে দিচ্ছে।গবেষক মিউনির কাছে এই গবেষণা শুধু বিজ্ঞান নয়, এটি মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বিজ্ঞানের নানা অজানা ক্ষেত্রের মধ্যে মস্তিষ্ককেই সবচেয়ে কম বোঝা গেছে। অথচ, এটিই আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × five =