পৃথিবীর ছাদের নতুন ব্যাখ্যা

পৃথিবীর ছাদের নতুন ব্যাখ্যা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৮ মে, ২০২৫

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভূগাঠনিক প্রক্রিয়ার রহস্যময়তার এক অনন্য নিদর্শন হল পৃথিবীর ছাদ বা তিব্বত মালভূমি। গুরুমণ্ডলের চমকপ্রদ উত্থানই নাকি এই মালভূমিটি সৃষ্টির মূল কারণ। কিন্তু
একটি নতুন গবেষণা এই ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ভারত-এশিয়া পাতের সংঘর্ষ ও তিব্বত মালভূমির উত্থান সিনোজোয়িক যুগেই ক্রমান্বয়ে ঘটেছিল – এই ধারণার পরিবর্তে তা দেখায় যে, এই স্বল্পস্থায়ী সংঘর্ষটি প্রাক-সিনোজোয়িক যুগের। এবং মালভূমির উত্থান পরবর্তী সিনোজোয়িক যুগের সংঘর্ষ পরবর্তী গুরুমন্ডলীয় পরিচলন প্রক্রিয়া দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। অর্থাৎ
তিব্বত মালভূমির উত্থান মুলত ঘটেছিল গুরুমন্ডলীয় গতিশীলতার কারণে, চলমান ভারত- এশীয় পাতের অভিসারী ক্রিয়ার ফলে নয়। এই গবেষণাটি দীর্ঘকালীন ভূ -ত্বকীয় গঠনমূলক মডেলকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ভারত-এশিয়া মহাদেশীয় পাতের সংঘর্ষ, তিব্বত মালভূমির উত্থান ঐতিহ্যগতভাবে দুটি প্রধান অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গোটা সিনোজোয়িক যুগ জুড়ে ঘটে চলা অভিসারী চলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভারত-এশিয়ান পাতের সংঘর্ষ চলমান এবং ভারতীয় উপমহাদেশে তিব্বতের পশ্চাৎভূমির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে। নতুন গবেষণাটি ভূ-তাত্তিক, ভূ-গাঠনিক এবং ভূ-রাসায়নিক তথ্যের উপর বিস্তর বিশ্লেষণ করে সেই অনুমানগুলির বিরোধিতা করে। এটি সংঘাতমূলক প্রক্রিয়ার সময় স্থানিক প্রভাবের পরিমান ও সংঘর্ষ পরবর্তী বৈশিষ্টের গঠনগত ও কাঠামোগত পার্থক্যের ওপর জোর দেয়।
অনুসন্ধানগুলি জানাচ্ছে যে, ভারত- এশিয়া পাতসীমান্তে সংঘর্ষকারী পর্বত গঠনের প্রক্রিয়াটি খুব সংক্ষিপ্তই ছিল। এটি প্রাক-সিনোজোয়িক যুগে ঘটেছিল এবং তিব্বতের পশ্চাৎ অংশের নীচে ভারত মহাসাগরীয় পাতের নিবেশিত হওয়ার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। পরিবর্তে তিব্বতীয় মালভূমির উত্থান গুরুমন্ডলীয় গতির দ্বারা চালিত হয়েছিল। যা কিনা সংঘর্ষ পরবর্তী সিনোজোয়িক যুগের ঘটনা।
গবেষকরা জোর দিয়ে দেখিয়েছেন যে, তিব্বত মালভূমি একটি একক সংঘর্ষ প্রক্রিয়ার দ্বারা গঠিত অভিন্ন কাঠামো তো নয়ই, বরং ভূখণ্ডের একটি জটিল ছক বাঁধা নিদর্শন। এটি প্রাক- প্যালিওজোয়িক যুগ থেকে মেসজোয়িক পর্যন্ত উত্তরাভিমুখী হয়েছে।
এই ভূখণ্ড ও তাদের সংযোগস্থলগুলি(সুচার) সম্পূর্ণ সিনোজোয়িক যুগের একটানা সংঘর্ষের পরিবর্তে স্বল্পস্থায়ী প্রাক- সিনোজোয়িক সংঘর্ষের সময় পুনরায় সক্রিয় হয়েছিল।
ভারত- এশিয়ার পাতসীমানা বরাবর সংঘর্ষের সবচেয়ে সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল হিমালয় এবং গাঙ্গেয় পার্বত্য অঞ্চলের পর্বতগুলির ওপর। গবেষণার ফলস্বরূপ , মূল অনুসন্ধানের ফলাফল দুটি সাধারণ অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রচলিত দৃষ্টান্তগুলিকে ভেঙ্গে দেয়। সিসমিক টমোগ্রাফী এবং হিলিয়াম আইসোটোপের তথ্য ভারতীয় উপমহাদেশের ২০০-৩০০ কিলোমিটার গভীরতায় সীমাবদ্ধ্ব। তা মূলত ইয়ারলুং- সাংপো সুচারের নীচে তিব্বত মালভূমির দক্ষিণতম প্রান্তকে চিহ্নিত করে। বৃহৎ ভারতের প্রস্থ সম্পর্কিত পুরাচুম্বকীয় তত্ত্বের অসংগতিগুলি হালকা সংঘর্ষ ও অগভীর নিবেশিকরনের সময় আচ্ছাদিত ভিতের পৃথকীকরণের উপর জোর দিয়ে সমাধান করা হয় । শিলাতাত্বিক, গাঠনিক ও শিলার বয়স নির্ধারণকারী তথ্যের একটি সমালোচনামূলক পরীক্ষা হিমালয়ের গাঠনিক প্রক্রিয়াকে দুভাগে ভাগ করেছে। এক, কঠিন সংঘর্ষের মাধ্যমে নমনীয় সংঘর্ষ থেকে গভীর অধোগমন পর্যন্ত মহাদেশীয় নিবেশীকরন। দুই, সংঘর্ষ-পরবর্তী পুনর্নির্মাণ ।
বর্তমানে পাত-সংস্থানগত প্রক্রিয়াকে পুনরায় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ।এই সমীক্ষা প্রমাণ করে যে ভারত-এশিয়া সংঘর্ষের জন্য দুটি সাধারণ অনুমান আর নিবিড় বিবেচনার অধীনে নেই । সিনোজোয়িক যুগে হিমালয়-তিব্বতীয় পাত- সংস্থানগত বিবর্তনে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এটি ভারত ও এশিয়ার মধ্যে মহাদেশীয় অভিসারী সংঘর্ষ এবং অধোগমন সম্পর্কিত পুরাচুম্বকীয় এবং ভুকম্পন তথ্য সম্পর্কিত গঠনমূলক ব্যাখ্যা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে।
ভূতাত্ত্বিক এবং ভূ-রাসায়নিক পর্যবেক্ষণের অনেকগুলিকেই দুটি অনুমানের অধীনে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। সংঘর্ষ কালীন প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে সাময়িক ক্রম, গতিশীল অবস্থা এবং ভূ-তাপীয় নতির একাধিক পার্থক্যকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। অতএব, সংঘর্ষকালীন প্রভাবগুলির চেয়ে সংঘর্ষ-পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে ভারত-এশিয়া সংঘর্ষ এবং মালভূমি উত্থানের প্রক্রিয়াটিকে, এবং প্রভাবগুলির জন্য ভূ-গতিশীল মডেলগুলির যৌক্তিকতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 − 8 =