দৈনন্দিন জীবনে নদী-বাঁধের ভূমিকা অপরিহার্য। নদীর গতিপথ থামানো, কৃত্রিম হ্রদ তৈরি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষির সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানীয়জল সংরক্ষণ সবই এই বাঁধের উপর নির্ভরশীল। বাঁধের এই কাজগুলি আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবসম্মত ও টেকসই। কিন্তু পৃথিবী যেহেতু নিজ কক্ষকে ঘিরে ঘুরছে, তাই এত পরিমাণ জল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো, আমাদের গ্রহের উপরও সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, গত দু -শতাব্দীতে হাজার হাজার জলাধার তৈরি করার ফলে, পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থান উত্তর ও দক্ষিণ মেরু থেকে প্রায় এক মিটার সরে গেছে। দৈনন্দিন জীবনে অবশ্য এই পরিবর্তন অনুভব করা যায় না। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে পৃথিবীর ঘূর্ণন ও ভরের বণ্টন ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। ঘূর্ণনশীল যেকোনো বস্তুর মতোই, পৃথিবীও স্থিতিশীল ঘূর্ণনের জন্য নিজের ভরকে সমানভাবে ছড়িয়ে রাখতে চায়। বিশেষত নিরক্ষরেখার কাছাকাছি। কিন্তু যখন একটি অঞ্চলে অতিরিক্ত ভর জমা হয়, যেমনটা হয় বড় বড় জলাধারে জল আটকে রাখলে—তখন সেই ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে। পৃথিবী তখন তার ভূ-পৃষ্ঠ ও উপরের ম্যান্টলকে সামান্য পুনর্বিন্যাস করে এই চাপের প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ট্রু পোলার ওয়ান্ডার’। এর ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ, মহাকাশে একই দিকে থাকে, কিন্তু পৃষ্ঠতল সামান্য ঘুরে যায়। ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উপর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর অবস্থান ধীরে ধীরে সরে যায়। তবে এটি পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর পরিবর্তন বা প্লেট টেকটোনিকজনিত গতিবিধির মতন নয়।
১৮৩৫ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত মানুষের তৈরি ৭,০০০–এর বেশি বড় বাঁধের কারণে ব্যাপক পরিমাণ জল, সমুদ্র থেকে উঠে এসে স্থলভাগের জলাধারে জমা হয়েছে। আগে যে জল পাতলা একটি স্তরে বিশ্ব সমুদ্রে ছড়িয়ে ছিল, এখন তা উত্তর-পশ্চিম আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার মতো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বড় “জল-পিণ্ড” বা ‘মাস ব্লব’-এর আকারে আটকে আছে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিক থেকে এই পরিবর্তন ছোট হলেও পরিমাপযোগ্য। গবেষক দল পৃথিবীকে একটি ঘূর্ণায়মান, স্থিতিস্থাপক গোলকের মতো ধরে তাদের গণনা করেন। স্থলভাগে প্রচুর জল জমলে, ভূ-পৃষ্ঠ সামান্য বেঁকে যায়, মাধ্যাকর্ষণ বলের বিন্যাস বদলে যায়। ফলে, পৃথিবীর বাইরের স্তর অতি সূক্ষ্মভাবে নতুন অবস্থানে সরে যায়। একই সঙ্গে সমুদ্রও প্রতিক্রিয়া দেখায়। সমুদ্রের পৃষ্ঠ সর্বদা মাধ্যাকর্ষণ ও ঘূর্ণনের সম্মিলিত প্রভাবে তার ভারসাম্য খোঁজে। তাই জলাধার পূরণের জন্য জল সমুদ্র থেকে বেরিয়ে গেলে তা সব জায়গায় সমানভাবে কমে না। বরং বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্নভাবে সামঞ্জস্য গড়ে ওঠে। এই সব উপাদান, স্থলভাগের জলাধারের সরাসরি চাপ এবং সমুদ্রের পুনর্বিন্যাস নিয়ে এ গবেষণায় একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। ফলাফল থেকে দেখা গেছে, ১৮৩৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে মানুষের তৈরি জলাধারগুলো মিলে পৃথিবীর ভৌগোলিক মেরুকে প্রায় ১.১৩ মিটার (৩.৭ ফুট) সরিয়ে দিয়েছে। এর বেশিরভাগই ঘটেছে বিশ শতকে, যখন বিশ্বজুড়ে বড় বড় বাঁধ নির্মাণ দ্রুত বেড়েছে। মেরু সরে যাওয়ার অভিমুখও সময়ের সঙ্গে বদলেছে। ১৮০০–এর মাঝামাঝি থেকে ১৯০০–এর মাঝামাঝি পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে বড় বাঁধ বেশি তৈরি হয়েছিল, ফলে উত্তর মেরু ধীরে ধীরে রাশিয়া ও এশিয়ার দিকের দ্রাঘিমাংশ বরাবর প্রায় ১২ ইঞ্চি সরে যায়। ১৯৫৪ সালের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় বিশাল বিশাল জলাধার গড়ে ওঠায় মেরু আবার বিপরীত দিকে, অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। কয়েক দশকে এই পরিবর্তন একটি নতুন ভৌগোলিক পথ তৈরি করে।
গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সমুদ্রপৃষ্ঠ। সাধারণত আমরা শুনি, সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রতি বছর কয়েক মিলিমিটার করে বাড়ছে। কিন্তু পৃথিবীর ভর-বণ্টনের পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়া বা কমার আলাদা “আঙুল ছাপ” তৈরি হয়। বাঁধে জল আটকে রাখার ফলে সেই বিশ্ব প্যাটার্ন সামান্য পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি বিশ শতকে বরফ গলার কারণে যে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়ার কথা, জলাধারে জল আটকে রাখার ফলে তার কিছুটা অংশ “ঢেকে” গেছে। প্রধান গবেষক নাতাশা ভ্যালেনচিক বলেন, “আমরা যখন জলাধারে জল আটকে রাখি, তখন শুধু সমুদ্রের জল কমাই না, পৃথিবীর ভর বণ্টনও পাল্টে দিই। মেরু মাত্র এক মিটার নড়েছে বলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হবে না, তবে এর প্রভাব সমুদ্রপৃষ্ঠের উপর পড়বেই।“ নিঃসন্দেহে মানুষের প্রকৌশলগত কাজ, পৃথিবীর ঘূর্ণন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের ইতিহাসে চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জানান, এই জ্ঞান ভবিষ্যতে পৃথিবীর মেরু সরে যাওয়া, বরফ গলার হার ও সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন আরও নির্ভুলভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
সূত্র : True Polar Wander Driven by Artificial WaterImpoundment: 1835–2011N. Valencic1 , E. Speiser; Geophysical Research Letters.
