প্রতিভাবান শিশু কে? 

প্রতিভাবান শিশু কে? 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

অনেক বাবা-মা মনে করেন, যেসব বাচ্চা ক্লাসে প্রথম সারিতে থাকে, তারাই প্রকৃত ‘প্রতিভাবান’। কিন্তু গবেষণা বলছে, মেধাবী শিশুরা অনেকসময়ই ক্লাসে সবার শীর্ষে থাকে না। কিছু শিশু বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষায় ৯৯.৯ শতাংশের উপরে নম্বর পেলেও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না, সময়মতো কাজ জমা দিতে পারে না, কিংবা গ্রেড নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায় না। স্পেনের আলিকান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা, এমন প্রতিভাবান শিশুদের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করেন। আর তাঁরা প্রতিদিনই এই বৈপরীত্য দেখতে পান। তাদের মতে, সক্ষমতা আর বিদ্যালয়ের ফলাফল এক জিনিস নয়। শিক্ষাবিদদের সংজ্ঞায় প্রতিভা মানে কোনো শিশু এক বা একাধিক ক্ষেত্রে তার সমবয়সীদের তুলনায় অস্বাভাবিক উন্নত ক্ষমতা দেখায় – শুধু পরীক্ষার নম্বরে নয়। আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর গিফটেড চিলড্রেন জানায়, প্রতিভাবান শিশু সব জাতি, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে আসে। বোধবুদ্ধির পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এসব শিশু তথ্যকে দ্রুত প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। একই সঙ্গে সমস্যার বেশি অংশ নিয়ে ভাবতে পারে। ফলে তারা নতুন বিষয় দ্রুত শেখে, কিন্তু ধীর গতির ক্লাসরুম তাদের বিরক্ত লাগে। অনেক সময় একটি প্রতিভাবান আট বছরের শিশু, মাধ্যমিক স্তরের মতো পড়তে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে জুতোর ফিতা বাঁধা বা খোলায় হার মানতে না পারার মতো ছোট বিষয়েও ভেঙে পড়ে। গবেষকেরা এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধি, অর্থাৎ চিন্তা, সামাজিক দক্ষতা ও আবেগগত পরিপক্বতার অসম বিকাশকে বিসমলয় বিকাশ (“অ্যাসিঙ্ক্রোনাস ডেভেলপমেন্ট”) বলেন। সম্প্রতি ১৭টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে, স্কুলগুলি কীভাবে প্রতিভাবান শিশু শনাক্ত করে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু বুদ্ধি-অঙ্ক মেপে বা পরীক্ষার ফল দেখে নয়, সামগ্রিক বোধবুদ্ধির ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই তাদের প্রতিভা শনাক্ত করা বেশি ফলপ্রদ। এমনও দেখা যায়, প্রতিভাবান শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহাকাশ বা ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে পারে, কিন্তু দাঁত ব্রাশ করতে কিংবা ব্যাগ গোছাতে ভুলে যায়। তাদের চিন্তার গতি অনেক এগিয়ে, কিন্ত দৈনন্দিন দক্ষতা থাকে পিছিয়ে। এটি বড়দের অনেকসময়ই বিভ্রান্ত করে। অন্যায়, দুঃখের গল্প বা রুটিন বদলে যাওয়া এদের গভীরভাবে নাড়া দিতে পারে। এক ক্লিনিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিভাবান শিশুদের মনোযোগের সমস্যা ও অতিরিক্ত চঞ্চলতার অভিযোগ বেশি। তাদের নিজেদের সামাজিক দক্ষতা ও শারীরিক সুস্থতাও গড় মানসিকতার শিশুদের তুলনায় কম বলে উল্লেখ করেছে। এমন বাচ্চা খুব ছোট বয়সেই বড় প্রশ্ন করতে শুরু করে। যেমন, মৃত্যু, দারিদ্র্য, জলবায়ু সংকট বা মানুষের মধ্যে সহিংসতার কারণ কি! খেলার মাঠে গুন্ডামির গল্পও তাদের কাছে সমাজ কীভাবে কাজ করা উচিত, ন্যায়বিচার কী, এসব বড় প্রশ্নে পৌঁছে দেয়। এই গভীর বোঝাপড়া এবং অসম পরিপক্বতা তাদের মনে ভয়ের বোঝা বাড়িয়ে দিতে পারে। অনেক শিশু খুব সংবেদনশীল হওয়ায় কার্টুনে কোনও চরিত্র আঘাত পেলে মন খারাপ করে। আবার কেউ কেউ অবসরে জটিল গল্প লেখে, রসায়ন নিয়ে কৌতুক করে বা মেট্রোর মানচিত্র মুখস্থ করে। বড়দের কাছে অদ্ভুত মনে হলেও তাদের কাছে এটি স্বাভাবিক। অভিভাবকেরা কখনও কখনও ভাবেন, এসব আগ্রহ বয়স্ক সুলভ, তাই শিশুকে বয়স–উপযোগী খেলাধুলায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এতে শিশুর মনে হতে পারে তার কৌতূহল ভুল। স্কুলে এগিয়ে থাকা বাচ্চারা পাঠ্যক্রমের চেয়ে দ্রুত শেখে, ফলে একই বিষয় বারবার শুনে তারা বিরক্ত, উদাস বা কখনও তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়ে। কিছু শিশু প্রতিভাবান হলেও কোনও শারীরিক বা শেখার সমস্যা থাকে, যা স্কুলজীবনকে কঠিন করে তোলে। গবেষণা বলছে, স্কুলগুলি প্রায়শই তাদের দুর্বলতার দিকে বেশি নজর দেয়, শক্তির দিকটি উপেক্ষা করে। শিক্ষকেরা অনেক সময় ধরে নেন, প্রতিভাবান মানেই গুছিয়ে চলা, অনুপ্রাণিত হয়ে থাকা, মার্জিত থাকা। ফলে যে শিশু অগোছালো বা নড়বড়ে, তাকে ‘অলস’ ভেবে প্রতিভাবান তালিকায় পাঠানোর কথা ভাবেন না। এতে নিম্ন–আয়ের পরিবার বা প্রান্তিক সম্প্রদায়ের শিশুরা আরও বঞ্চিত হয়। এক্ষেত্রে, অভিভাবকেরা উন্নত চিন্তা, তীব্র আবেগ বা শেখার সমস্যার উদাহরণ লিখে রাখতে পারেন। পরে স্কুল–মনোবিজ্ঞানী বা চিকিৎসকের সঙ্গে তা ভাগ করে নিলে মূল্যায়ন সহজ হয়। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটি মাত্র স্কোরের বদলে শিক্ষকের পর্যবেক্ষণ, পারিবারিক নথি ও পেশাদার মূল্যায়ন একসঙ্গে দেখা বেশি প্রয়োজনীয়।

 

সূত্র: The Identification of Giftedness in Children: A Systematic Review

by Laritza Delgado-Valencia ; Educ. Sci. 2025, 15(8),

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × one =