রাজা হরিশচন্দ্র ‘মহারাজা’ হয়েছিলেন দান ধ্যানের জোরে। বসন-আসন, ধন-দৌলত, বিষয়-আশয় ইত্যাদি রাজধর্মের সব বৈভব ছাড়তে ছাড়তে একসময় তিনি ছেড়েছিলেন পরিবার-পরিজন, প্রজাকুল এবং শেষমেশ সিংহাসন। তাঁর এই অক্ষয় জীবনের শেষ ক’টা দিন কেটেছিল মানবজীবনের শেষ ইস্টিশানে- যার নাম শ্মশান। তাঁর প্রজাদের কী হাল হয়েছিল মহাকাব্যে লেখা নেই- যেমন লেখা নেই এই রাজন্যের এই বেপথু প্রবৃত্তির উদ্ভবের সূত্র এবং বিকাশের ধারা ! যেহেতু মহাকাব্যের ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে,তাই ভাবা যেতেই পারে হরিশচন্দ্র ইতিহাসের নায়ক-‘মাইথোলজি’র কল্পনায়ক নন।
এটাও ভেবে নেওয়া ভালো তাঁর এই চিন্তা ‘অন্তর্দৃষ্টির ফসল’-তা যতই অবিবেচনা প্রসূত বলেই মনে হোক ! রাষ্ট্রেরও দর্শন থাকে, রাষ্ট্রচালক তারই মুখ এবং মুখোশ দু’টো হাতে নিয়ে বসে থাকেন। ইতিহাসে দেখা গেছে- প্রয়োজন মতো রাষ্ট্রনায়ক মুখোশ ধারণ করেন-যেটা মূলতঃ কৌশল। দৃষ্টিভঙ্গি কৌশলকে পরিচালিত করে- উল্টোটা ঘটলে সব্বোনাশ! বেশি কৌশলী হতে গেলে অন্তর্দৃষ্টি ঢাকা পড়ে বা তাতে মরচে ধরে, আপস আর অভিসন্ধি জীবন দর্শনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়, ‘দান-ধ্যান’ হয়ে দাঁড়ায় ‘আরও বেশি পাওয়ার’ সোপান। এবং সমাজের পক্ষে তা মঙ্গলের হয় না! এটা ইতিহাসে ঘটে থাকে এবং তা ঘটে মূলতঃ ঘটে তখনই, যখন রাষ্ট্রপরিচালনার পাখির চোখ সমাজের কল্যাণ বা উন্নয়ন থেকে সরে গিয়ে-ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির বাহক হ’বার দিকে এগিয়ে চলে।
স্বাস্থ্য পরিচালনার অভিমুখ এবং পরিচালকদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করতে বসে হরিশচন্দ্রকে স্মরণ বাচালতা বলে মনে হলেও, করতে হচ্ছে এই কারণে যে আমাদের দেশের বর্তমান রাজারাও দানধ্যানে মেতেছেন হয়তো বা মহারাজ হওয়ার নেশায়। গলার হার, পরনের ব্যসন হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান- যা তাদের কাছে মনে হচ্ছে পরিধেয় অথবা বহনযোগ্য নয়। মহারাজার সাথে নব্যরাজের তফাতটা হচ্ছে এই যে, সিংহাসন আরও সুচারুভাবে সংহত করার লক্ষ্যে, রাজকাজ আরও প্রজাকল্যাণকর করার মোক্ষে- তারা রাজ প্রতিষ্ঠান তুলে দিতে চান- বণিক সম্প্রদায়ের হাতে। সাধারণের হাতে নয়। পরিচালন কাজে এরা নাকি দক্ষ। বেশি হৃদয়শালী হলে রাজকাজ চালানো যায় না। প্রজারা দুঃখ না পেলে রাজার প্রয়োজন অনুভব করে না- তাই দুঃখ থাকুক, বাগান ঘেরা- ‘নব্য হরিশচন্দ্র’দের দর্শন এটাই।
পাবলিক সেক্টর বলে কিছু সেকালে ছিল না- থাকলেও না স্বাস্থ্যে ছিল না। সভ্যতা আর সমাজ উন্নয়নের পথ বেয়ে সমাজের মানুষের কল্যাণের যে বিষয়গুলি পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপরিচালকরা লাভের নয়, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োজনীয় বলে গুরুত্ব দিয়েছেন তার অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য। আত্মরতি, ইংরাজিতে যাকে বলে সেলফ মিউটিলেশন, এক মানসিক ব্যাধি। সমাজই যদি তাতে প্রমত্ত হয়, তাহলে তা আর যাই হোক কল্যাণকর হয় না বেশির ভাগ মানুষের জন্য। তাই এই ধান ভাঙতে শিবের গীত। নতুন যুগের হরিশচন্দ্রের দান ধ্যানের সব থেকে প্রিয় বস্তু হচ্ছে প্রজাদের জীবনরক্ষার প্রয়োগ কৌশল। যা চিকিৎসা স্বার্থে প্রচলিত। তাই বলিপ্রদত্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের স্বাস্থ্য এক নতুন পথে হাঁটছে। পাবলিক নয়, প্রাইভেট অথবা প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ! প্রেক্ষিতটা একটু দেখা যাক।
অদ্ভুত সময় এখন ! সরকার, সরকারি কর্মী এবং ভোক্তা সাধারণ মানুষে কেউই যেন পছন্দ করতেন না সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে। যুক্তি এবং কারণগুলি কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। সরকার কেমন যেন হতাশ গোছের- বেহায়া সন্তানকে বশে আনতে না পেরে যা খুশি করো মনোভাব নেওয়া বাবার অবস্থানের সাথে তার সাযুজ্য আছে। সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা খারাপ কাজ করছেন- ব্যাপারটা অন্যভাবে বলতে হয়। অনেকটা ‘ভাসুরঠাকুর’ ভালো নয় বলতে গেলে যেমন ঘোমটা নিতে হয় সেরকম।সরকারি কেষ্টবিষ্টুরা বলে থাকেন- ‘সরকারি কর্মীদের একাংশ কাজ করেন না- বেশিরভাগই অমনোযোগী।’ এটা ভাবাটাই বোধহয় ভালো। এ রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা আবার ইদানীং একই স্বাস্থ্য প্রকল্প নিয়ে ভীষণ উৎসাহী, মাননীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা করলেও চলবে- খরচ সরকারই বহন করবে। এতে বেশ কিছুজন প্রীত, কারণ অপরিচ্ছন্ন সরকারি হাসপাতালেই মাত্র চিকিৎসা করালে খরচ পাওয়ার যে হোক ছিল- তা আরও বিস্তীর্ণ, আরও মনোগ্রাহী ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। দাম বেশি ছিল বলে মন চাইলেও সরকারি কর্মীরা যে চিকিৎসা কিনতে পারতেন না, এবং সেই লঝঝরে সরকারি চিকিৎসার উপরই ভরসা করতে হত গত্যন্তর না থাকায়- তা এখন অনেক ব্যপ্ত! অতএব ‘দেহ’ সরকারি আলোয় দিনাতিপাত করলেও ‘মন’ কিন্তু ‘বেসরকারি’ কেন্দ্রের দিকেই আকর্ষিত, তাদেরও!
আর ভোক্তা সাধারণ মানুষ? এঁরা দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাধ্যকতার দিক দিয়ে বহুধা বিভক্ত। কিন্তু সরকারি চিকিৎসালয়ের নির্জীব, নিষ্প্রাণ, দায়সারা দৃষ্টিভঙ্গি পীড়া দেয় প্রত্যেককেই! ‘হাসপাতাল’ আর ‘অফিসের’ মধ্যে ফারাক করতে না পারা অথবা না-করা কর্মীকুল, রোগীর জন্য কাজ করে ‘দয়া করছি’ গোছের হাবভাব থেকে। আন্তঃদপ্তরীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিতান্তই বিশৃঙ্খলা এবং ‘বৃন্দাবনের রাখাল’রূপী দালাল বর্গ- এই বহুধা প্রেমে ক্ষতবিক্ষত মানুষ এখনও সরকারি চিকিৎসালয়ে যান মূলত তিনটি কারণে। এক, আর্থিক ক্ষমতার অভাব; দুই, এখনও বিশ্বাস সরকারি পরিষেবা উন্নত; তিন, বেসরকারি ক্ষেত্র অপরিচ্ছন্ন চলনে বলনে। স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণের এই যে ‘চয়েস’ তারও একটা সংস্কৃতি আছে যাতে গ্রাম শহরের প্রভেদ আছে। গ্রামের মানুষ এখনও সরকাই চিকিৎসালয় বেশি পছন্দ করেন। শহরের নিম্নবিত্তরাও তাই মনে করেন। মোদ্দা বিষয়, সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা এখনও ভার বইছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে- যত্নহীনভাবে। ‘সভ্যতার পিলসুজে’র!
পাঁচিলের অন্য পিঠে আছে বেসরকারি পরিষেবা, রূপ আছে, রস আছে, রঙ্গ আছে- ‘আত্মা’ অতলে! বৈভব, যন্ত্রপাতির ঝনঝনানি, মিষ্টভাষী- নেকটাই শোভিত সুবেশ কর্মী এবং চিকিৎসক দলে, বিদেশীকুলগোত্রহীন ডিগ্রী ডিপ্লোমার বিপণন, বোর্ডরুমে লাভক্ষতির হিসাব আর গ্রামে গঞ্জে অ্যাম্বুলেন্স-এর ছোটাছুটি- এই হচ্ছে প্রচলিত বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবার রূপ। প্যাকেজের মোহে আবিষ্ট হয়ে প্রবেশ, দিনযাপন রোগমুক্তির আশায় হাসপাতালের পাওনার স্লিপে আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি- এ নিত্যকার কাহিনি এই নব্য সভ্যতার। ব্যবসা করছি কি লোকসানের জন্য? জানেন এই প্রতিষ্ঠান চালাতে কত টাকা খরচ হয়? প্রতি মুহুর্ত ‘সেবা’র কণ্ঠিমালা জপ করে যে ব্যবসায়ী সরকারি জমি বিনা পয়সায় অথবা নামমাত্র পয়সায় হস্তগত করেছেন- সরকারি অফিসার বা নেতার কাছে থাকার জোরে- তারই কন্ঠস্বর এটা। এদেরই রামালালার মন্দিরের গর্ভগৃহ হচ্ছে আই সি ইউ নামের সুড়ঙ্গ। সেখানে বিজ্ঞানের আলো জ্বলে- ভবানীপুরের ‘উড়ে পাড়ায়’ যেরকম ট্যাক্সির মিটার তৈরী হয়, সেরকমই- সেরকমই উড়ন্ত মিটার শোভিত হয়ে। আলু পটল বিক্রির সময়ও তার একটা মূল্য নির্ধারিত থাকে তার উপর নজরদারিও থাকে! কিন্তু চিকিৎসা এমন একটা ব্যবসা- যেখানে নির্দিষ্ট কোনো মূল্য নেই। ‘আমি সর্বোত্তম’ হাঁক পেড়ে একই চিকিৎসার জন্য মূল্যমান এই ক্ষেত্রে একশোভাগ পর্যন্ত ওঠানামা করে! ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে তা বদলায়- গ্রাম শহরের মানুষ অনুযায়ী, কখনও বা ইন্সিওরেন্স আছে কিনা তা দেখার পর। বিনোদন, ভোগ্যপণ্য আর বিজ্ঞান এই ত্রিধারায় সম্মিলনে বিকশিত এই পরিষেবা (!) ক্ষেত্র ক্রমশ” হাত বাড়াচ্ছে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারের স্নেহে সিক্ত হয়ে। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন যে কাজের ক্ষেত্রে নেউ, হিসাব নেওয়ার জন্য যে ব্যবসায় কেউ এসে প্রশ্ন করেন না- তা যে যেমন খুশি হাঁটবে- বলাই বাহুল্য। ‘উন্নয়ন’ নামক মোহে আমরা যখন সর্বাঙ্গ মথিত, তখনই এই বেসরকারি ক্ষেত্র আমাদের আমেরিকার স্বপ্ন দেখায়। যে দেশে বেশিরভাগ মানুষ মারা যায় ডায়রিয়া, টিবি এবং ম্যালেরিয়ায়, সেই দেশেই উন্নত (!) স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রচার করে এবং প্রসার করে যে হার্টের রোগ আর ডায়াবেটিস বাগে আনতে পারলেই দেশের কল্যাণ! দেশের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে দেশের সামাজিক এবং আর্থিক পরিকল্পকদের ধ্যানধারণা বদলে দেবার জন্য এরা সমীক্ষা করেন, বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষাও করেন- তা প্রকাশিতও হয় দুনিয়ার বিখ্যাত সব জার্নালে। এগুলি হচ্ছে এই ব্যাবসায়ের থিংকট্যাংক। অর্থনীতির সব থেকে ভালো ছাত্র এখন জীবনের মান উন্নয়নের দিক নির্দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেন না- করেন বিদেশী ব্যাঙ্কের সুদ কীভাবে বৃদ্ধি পাবে, আর্থিক প্রতারণার সুলুক সন্ধান। চিকিৎসাতেও তাই বিজ্ঞানের আলো যিনি বেশি পাচ্ছেন তিনি তা প্রয়োগ করছেন- অস্ত্রের মাথায়, প্রদীপের আগায় নয়। ‘আগুন’ এখানে উত্তাপ দেয় না, পুড়িয়েও দেয়।
বৌদ্ধিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যখন এরকম এক পরিস্থিতি, সরকারি পরিষেবা ও আত্মগ্লানিতে দগ্ধ আর বেসরকারি ক্ষেত্র লাভের সোনারখনির সন্ধানে প্রমত্ত, তখনই আবির্ভূত হয়েছে এক নতুন শব্দ- প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ। রুগ্ন সরকারি শিক্ষাক্ষেত্র অধিগ্রহণে যেমন মুক্ত অর্থনীতির জগতে এগিয়ে আসছেন সফল শিল্পপতিরা- সেরকম অনেকটা সরকারি পরিচালকদের আত্মগ্লানি এবং শুধু চাকরি করার প্রবণতা জায়গা করে দিচ্ছে এই চিন্তার, যে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিচালনা পদ্ধতিই একমাত্র স্বাস্থ্যচিকিৎসাকে আরও উপযোগী করে তুলতে পারে, ফলদায়ী করে তুলতে পারে। ফলতঃ বিভিন্ন প্রোগ্রামে এখন বেসরকারি বিকিকিনির সংস্কৃতির অংশগ্রহণ বাড়ছে। সরকারি হাসপাতাল কাজ করছে না, তাই তা তুলে দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে বেসরকারি হাতে। কখনও তা সফলভাবে হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, উল্টোটা কখনও দেখা যায় না। অর্থাৎ এই পার্টনারশিপ একমুখী, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সম্পত্তিকে আর্থিক দিক দিয়ে লাভজনক করার নাম করে বেসরকারি শিল্পপতির হাতে তুলে দেওয়ার এই গালভরা নামই স’সরকারি। সরকার সঙ্গে আছে- ‘অশোকস্তম্ভ’ও আমার। এটা স্বাস্থ্যের অগস্ত্য যাত্রী- স্টিল বা গোবরের ব্যবসাদার ‘সমাজসেবক’ হয়ে আবির্ভূত হচ্ছেন চিকিৎসা কেন্দ্রের স্থপতি রূপে। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে মানুষের লাভটা কী? সমাজেরই বা কী লাভ?
স্বাস্থ্যের এবং চিকিৎসার অভিমুখটা কী? এর ফলদায়িতা কি আর দশটা ভোগ্যপণ্যের মতো আর্থিক লাভখতির নিরিখে হবে? ‘উন্নয়ন’ গ্রোথ ইত্যাদি শব্দগুলি অটোমোবাইল বা স্টিল শিল্পে যে অর্থে ব্যবহৃত হয় চিকিৎসা ক্ষেত্রেও কি তাই হবে ? তাই হচ্ছে বেসরকারি চিকিৎসা ক্ষেত্রে। চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু ভিন্ন হওয়াটাই আশা করা যায়। শিল্পোন্নত দেশেও, যেখানে সমাজতন্ত্র নামে মোহময় দ্রব্যটি নাম খুব একটা হয় না, সেখানেও চিকিৎসা পরিষেবার থেকে আর্থিক লাভের আশা করা যায় না। এখানে লাভক্ষতির হিসাব হয় মানুষের সামগ্রিক আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে, প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষজনের কাছে কত ভালভাবে চিকিৎসাকে পৌঁছে দেওয়া যায় তার হিসাবে। দমকল, শ্মশান,চিকিৎসা, এগুলিকে পরিষেবা বলা হয় তো এই কারণেই-যে এগুলির থেকে সমাজের প্রত্যাশা অনেক বেশি অন্যরকমের। এগুলির চলনবলনও সমাজে অন্যরকম আশা করে। চিকিৎসার ক্ষেত্রটাও ভিন্ন- এখানে যদি এই লক্ষ্য হয় যে, রোগীর চিকিৎসার মধ্য দিয়ে আমার ‘লাভ কী’, তবে তা তো আর মানুষের চিকিৎসার থাকে না। হয় মানুষরূপী ‘কেসের’ চিকিৎসা। এখানেই চিকিৎসা পরিষেবা আর চিকিৎসা শিল্পের মুলগত তফাৎ। শিল্প বিপ্লবের তো অনেক বস্তু আছে থাক না, চিকিৎসাটা তার বাইরে। দম ফেলার জন্যেও তো সমাজের একটা বাগান লাগে- হোক না চিকিৎসা সেটা। আগুন আর জল যেমন মিশতে পারে না- সরকারি চিকিৎসা দৃষ্টিভঙ্গি আর বেসরকারি চিকিৎসা লোভাতুর চোখ- তাই এক পথে হাঁটতে পারে না। ‘উন্নত’ চিকিৎসা থাকুক- আপত্তি নেই। গৃহস্থের ঘরে বারবণিতার সাদর অভ্যর্থনা হোক- আপত্তি নেই। কিন্তু গৃহস্থ আর বারবণিতার সংস্কৃতি, জীবনের দর্শন আর পথ চলা তো ভিন্ন হবেই। থাকুন তাঁরা তাদের পাড়ায়- গৃহস্থ বাড়িটাকে আমরা আরও একটু উন্নত করি, সজীব করি।
আমরা এক আত্মভোলা, ভাববাদী শিল্পী বন্ধুকে অনুরোধ করেছিলাম স্বাস্থ্যের প্রবহমান ধ্যানধারণাগুলিকে তার দৃষ্টিতে উপস্থাপিত করতে। নিচের পরিচ্ছেদ তারই কলমের-
আগুনের রূপ জানো? সবসময় তা এগোয় লোভ নিয়ে। পোড়ায় সব- কড়ি-কাঠ-লোহা-মোম-ঘি-মাটি। শেষে ছোঁয় জলকে-আর তখনই থমকায়- পথ পালটায়। কিন্তু আগুন আগুনই- তার তাপ ভালো- স্পর্শ সুখদায়ী নয়। আর জল? ধুয়ে চলে সবকিছু শানবাঁধানো মেঝে, তাক লাগানো আলপনা, জমাট রক্তের দাগ- স-অব। যত মালিন্য – যত কালিমা সব ফিকে দিয়ে সবটুকু তিতিক্ষাকে বুকে জলের ধারা থমকে দাঁড়ায়- উনুনের কিনারায়- সেখানে জ্বলে গনগনে আগুন, সব পোড়ায় আগুনের জিভটুকু জলের ছোঁয়ায় হয় স্নিগ্ধ, ধৃষ্টতা হয় স্তিমিত। চোখ রাঙানো যে আগুনের সত্তার অংশ, তা নুইয়ে পড়ে জলের প্রবাহের দৃঢ়তার কাছে, আবেগের প্রাবল্যের মুখে, সারল্যের দীপ্তির সামনে। কিন্তু জল যখন গতি হারায়- আগুন পোড়ায় সবটুকু। জলের অন্তর্লীন স্বচ্ছতা আর মঙ্গলকামনার সাথে যদি আগুনের তেজ আর চটক মেশানো হয়, এক বাক্সে ঝাঁকানো হয় শক্তি উৎপাদন হবে- এখনও সভ্যতা তা বুঝে উঠতে পারেনি। হয়তো বা আসবে সভ্যতার কোনো নতুন স্তর। যা পদার্থের তিন রূপ- কঠিন, তরল, বায়বীয়র মতোই বাঁধাধরা ছকের বাইরে। সরলও নয়, গরলও নয়, বোঝা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না, পোড়ায়ও না- জুড়ায়ও না। জনন শক্তি রহিত মঞ্চাভিনয়ে দক্ষ, দাঁত আছে কিন্তু তা সোনা দিয়ে বাঁধানো – এরকম চেহারায় এক দঙ্গল প্রাণী সেখানে বাসা বাধবে। আগুনে পোড়া- জলে ডোবা মানুষ দলে দলে ছুটবে তাদের দেখতে – চাইবে কখনও বা সেখানে আশ্রয় পেতে। কালীপূজার রাতে রোশনাই দেখে বন-জঙ্গলের পোকা যেভাবে আলোর দিকে ছোটে- প্রাণ দিত। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অথবা অবিমিশ্র ভোগবাদের কোনো দার্শনিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সেখানে খাপ খাবে না। লেটো, আলকাপ আর ব্রেক ও বেলি ড্যান্সের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সবাইকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকবে এই মার্গে।
বুঝতে পারিনি শিল্পীর দার্শনিক অভিব্যক্তিগুলি। বড়ো জটিল ঠ্যাকে এসব। সমাজ বিশ্লেষণ তত্ত্বে কেউ যদি চারপাশকে বুঝতে চান- আমাদের মনে হয় হেঁয়ালিতে সময় নষ্ট হচ্ছে। আমারও তাই…। ‘বুঝলেন না’- আগুন হল বেসরকারি, জল হল সরকারি আর দুইয়ের মিশেল হল ‘স’ সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসার রূপকল্প আমার চোখে। ‘স’সরকারি শব্দটা সেই প্রথম শোনা, তাই প্রশ্ন ছিল এটা কি? ওই যে কি যেন রাজভাষায় বলে- প্রাইভেট- পাবলিক থুড়ি পাবলিক-প্রাইভেট রিলেশনশিপ।
বাহাদুর শুনছেন কি? রঞ্জন আসবেই আসবে। পার্টনারশিপের নয়, নন্দিনীর হাত ধরে, মানুষের রূপে। ওটা প্রাইভেট নয়, ‘পাবলিক’। ওটাই আমার আপনার সবার বাড়ি। একটু নিজের বাড়িটা গুছাই না আমরা! রঞ্জনের পথ চেয়ে!