প্রাগৈতিহাসিক রোদ-ছাউনি ও হোমো সেপিয়েন্স

প্রাগৈতিহাসিক রোদ-ছাউনি ও হোমো সেপিয়েন্স

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

প্রায় একচল্লিশ হাজার বছর আগে, পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রে এক বিশৃঙ্খল পরিবর্তন ঘটে। এর নাম লাশাম্পস পরিভ্রমণ। এই ঘটনায় ক্ষতিকারক সৌর বিকিরণ,পৃথিবীর প্রাকৃতিক সুরক্ষাকে সাময়িকভাবে দুর্বল করে দেয়। তবে প্রথম পর্যায়ের হোমো সেপিয়েন্সরা, এই অসময়ের মধ্যেও টিকে থাকে এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির দিকে এগোয়। সূর্যের তাপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে এরা গুহায় কৌশলগত আশ্রয়ের উদ্ভাবন ঘটায়। এমনকি
সেলাই করা পোশাক তৈরি করে! তবে তাদের আত্মীয় নিয়ান্ডারথালরা অভিযোজন করতে পারে না, ফলে শীঘ্রই অদৃশ্য হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা উন্নত ত্রিমাত্রিক মডেলিং এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যবহার করে, পৃথিবীর অতীতের ‘ল্যাশাম্পাস ভ্রমণ’ এর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এই ঘটনা মানুষের বিবর্তন এবং অভিবাসনকে কিভাবে প্রভাবিত করে, সে সম্পর্কেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেন। আজ থেকে প্রায় একচল্লিশ হাজার বছর আগে এই ল্যাশাম্পাস পরিভ্রমণ ঘটেছিল। তখন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বর্তমান শক্তির তুলনায় প্রায় ১০% দুর্বল হয়ে পড়ে। চৌম্বকীয় মেরুগুলি সম্পূর্ণরূপে উল্টে না গেলেও, বেশ খানিকটা বিপরীতে ঘুরতে থাকে। যার ফলে ইউরোপের উপরে তীব্র ক্ষতিকারক অতিবেগুনি বিকিরণ প্রবেশ করে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু এবং মহাকাশ বিজ্ঞানী অগ্নিত মুখোপাধ্যায় জানান, “গবেষণার মধ্যে আমরা সেই সমস্ত অঞ্চলগুলিকে একত্রিত করার চেষ্টা করছি, যেখানে চৌম্বকক্ষেত্র সংযুক্ত হতো না। যেখানে মহাজাগতিক বিকিরণ বা সূর্য থেকে নির্গত যেকোনো ধরনের শক্তি কণা মাটিতে প্রবেশ করতে পারতো”। এই অঞ্চলগুলির সাথে সেই সময়কার মানবীয় কার্যকলাপের বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ মিল পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য গুহার ব্যবহার বৃদ্ধি এবং প্রাগৈতিহাসিক ‘সানস্ক্রিনে’র ব্যবহার বৃদ্ধি। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটি, তার লাভা কেন্দ্রের ঘূর্ণনের ফলে উৎপন্ন হয়। এটি বৈদ্যুতিক স্রোত তৈরি করে এবং গ্রহের চারপাশে একটি চৌম্বক ঢাল তৈরি করে। যখন এই ক্ষেত্রটি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন পৃথিবী অনেক বেশি সৌর বিকিরণের কাছাকাছি চলে আসে। গবেষকরা স্পেস ওয়েদার মডেলিং ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করেছেন। এটি, ‘ইউ এম’ এর ‘সেন্টার ফর স্পেস এনভারমেন্ট মডেলিং’ এর তৈরি একটি পদ্ধতি। ল্যাশাম্পাস ভ্রমণের সময়, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র এবং মহাকাশের প্লাজমা সিস্টেম কিভাবে মিথস্ক্রিয়া করে, তা অনুকরণের জন্যই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এরপর ত্রিমাত্রিক মডেলগুলিকে একত্রিত করে,বিশ্বব্যাপী মহাকাশ-পরিবেশ পুনর্গঠন করা হয়। ফলস্বরূপ সিমুলেশনগুলি এমন এক চেহারার সন্ধান পায়, যা আজকের পৃথিবী থেকে নাটকীযরূপে আলাদা। বিশেষত ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকা মেরুপ্রভায় ঢেকে রয়েছে। অপরদিকে পৃথিবীর বিশাল অংশ সৌর মহাজাগতিক বিকিরণের সংস্পর্শে এসেছে। গবেষকরা মনে করেন, এই তীব্র সূর্যালোক থেকে বাঁচতে আদিম মানুষরা সুরক্ষামূলক কৌশল গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বিগত কয়েক দশক ধরে, একটি প্রধান নৃ-তাত্ত্বিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক মানুষের পার্থক্য ও তাদের বিলুপ্তির কারণ “,নৃবিজ্ঞানী রেভিন গার্ভে বলেন। তবে অবাক করার মতন বিষয় হল, সেই সময় সেলাই করা পোশাকের ব্যবহার! এই সময়ের হোমো সেপিয়ান্সদের সাথে সম্পর্কিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলিতে, সেলাইয়ের সরঞ্জাম ,আউল, সূঁচ, চাঁচুনির চিহ্ন মেলে – যা শরীর মাফিক পোশাক তৈরীর প্রমাণ। পোশাকগুলি যেমন ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করত তেমনি আবার ত্বককে, চড়া অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও রক্ষা করত বলে তারা মনে করেন। গবেষকরা বলছেন, সেলাই করা পোশাকের আরও সুবিধা হল, অতিরিক্ত উষ্ণতার ফলে আদিমানুষরা খাদ্যের সন্ধানে, তাদের আশ্রয়স্থল থেকে আরও দূরে ভ্রমণ করতে পারত। এক্ষেত্রে পোশাকই একমাত্র অভিযোজনের উপকরণ ছিল না। এই সময়কালে, হোমো সেপিয়েন্সরা ঘন ঘন গিরিমাটি ব্যবহার করা শুরু করে। গেরুয়া রং এবং আয়রন অক্সাইড দ্বারা গঠিত প্রাকৃতিক লাল বা হলুদ রঞ্জক এই গিরিমাটি। বহুদিন ধরে মানুষের সাজসজ্জা এবং প্রতীকী উদ্দেশ্যে এই মাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিছু পরীক্ষামূলক গবেষণায় দেখা যায়, এটির মধ্যে সানস্ক্রিনের মতন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গবেষকরা অনুমান করেন, ঠিক এই কারণেই গিরিমাটি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। আরো প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে জানা যায় এই সময়ে গুহায় বসবাসের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থলগুলি অতিরিক্ত বিকিরণ থেকে শারীরিক সুরক্ষা প্রদান করত। মুখোপাধ্যায় এবং গার্ভে উল্লেখ করেন যে গুহায় লুকিয়ে থাকা, গৈরিকের বেশি ব্যবহার, শরীরের মাপ মাফিক পোশাক সেলাই করা, এগুলি সমস্তই প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ডে রয়েছে। তিনি বলেন, ” আমি মনে করি ফলাফলগুলি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। এটি সেই সময়কার তথ্যগুলির উপরে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে”। উন্নত মানব-প্রযুক্তিগত আচরণ, চৌম্বকক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সময়ে হোমো সেপিয়ান্সদের কীভাবে নিয়েন্ডারথালদের থেকে আলাদা করে এবং সুবিধা নিয়ে বাঁচতে সাহায্য করে তা এখন বলা যায়। প্রাগিতিহাসের পাশাপাশি, ভবিষ্যতে চুম্বকীয় বিপরীতমুখী পরিবর্তন আমাদের আধুনিক জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে সেই সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে এই গবেষণা। বর্তমানে পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। উত্তর মেরু ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার কারণে যদি আবারও একই রকম ঘটনা ঘটে, তাহলে কি হবে সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়। তখন “আমাদের যোগাযোগ উপগ্রহগুলি কাজ করবে না। অনেক টেলিযোগাযোগ যা মাটিতে রয়েছে, তা বিচ্ছিন্ন হবে। মহাকাশ আবার ক্ষুদ্রতম ঘটনার দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে। মানবদেহের উপর প্রভাবের কথা তো বাদই দিলাম, কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও বড় রকমের প্রভাব পড়বে”, মুখোপাধ্যায় জানান। পরিশেষে বলা যায়,’ল্যাশাম্পাস ভ্রমণ’ই নিয়েন্ডারথালদের বিলুপ্তির একমাত্র কারণ ছিল না। এটি আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট যে পৃথিবীর চুম্বকীয়র ঢালকে হালকা ছলে না নেওয়াই ভালো। জীবন রক্ষায়, সেটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে এই ঘূর্ণন যখন থেমে যাবে, তখন কত দ্রুততার সাথে আমরা মানিয়ে নিতে পারব তার উপর নির্ভর করবে আমাদের বেঁচে থাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 − seven =