প্রাণীদের যূথচেতনা

প্রাণীদের যূথচেতনা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

পাখির বা মাছের মস্ত ঝাঁক, কিংবা হরিণের পাল – সবার চলনই যেন এক অদৃশ্য সূত্রে বাঁধা। তারা একসঙ্গে ঘোরে, একসঙ্গে বাঁক নেয়, কখনো সংঘর্ষ হয় না, অথচ কেউ কাউকে নির্দেশও দেয় না। এই বিস্ময়কর সমন্বয়ের আসল রহস্য উন্মোচন করেছেন জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব কনস্টান্স ও ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব অ্যানিম্যাল বিহেভিয়র-এর বিজ্ঞানীরা।

গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন মহম্মদ সালাহশুর। তিনি প্রমাণ করেছেন প্রাণীরা আসলে কোনো নিয়ম বা নির্দেশ মেনে চলে না, তাদের মস্তিষ্কই স্বাভাবিকভাবে একে অপরের সঙ্গে মিল খুঁজে নেয়। তারা বিশ্বকেন্দ্রিক মস্তিষ্কের দিকনির্দেশনা ব্যবহার করে সমন্বয় ঘটায়। যার ফলে গোটা দল একই ছন্দে চলে।

গবেষণার চালিকা ধারণাটি হলো অ্যালোসেন্ট্রিক স্পেশিয়াল কোডিং । অর্থাৎ প্রাণীরা দিক নির্ধারণ করে বাইরের পরিবেশের স্থায়ী চিহ্নগুলি দেখে (যথা -পাহাড়, আলো, গাছপালা), নিজের শরীরের অবস্থান দেখে নয়। এরই নাম বিশ্বকেন্দ্রিক দিকনির্দেশনা। ফলে দিক নির্ধারণ থাকে স্থিতিশীল ও একীভূত।

ফলমাছি থেকে স্তন্যপায়ী পর্যন্ত সবার মস্তিষ্কেই আছে এক আশ্চর্য বৃত্তাকার বর্তনী বা রিং অ্যাট্রাকটার নেটওয়ার্ক, যা একপ্রকার দিকনির্দেশনার কম্পাস। যখন প্রাণীটি ঘোরে, এই বর্তনীতে একটি আলোর বিন্দু বা নিউরাল বাম্প ঘুরতে থাকে। যেন মস্তিষ্ক নিজেই তার অবস্থান চিনে নেয়।

এই একই ধরনের স্নায়বিক বিন্যাস একদল প্রাণীর মস্তিষ্কে একসঙ্গে কাজ করে, ফলে তারা একই ছন্দে চলতে পারে। ঠিক যেমন অর্কেস্ট্রায় একাধিক যন্ত্র একসাথে বাজে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণীরা কখনো কখনো দেহকেন্দ্রিক দিকনির্দেশনা ব্যবহার করে। অর্থাৎ, নিজের অবস্থান ধরে দিক নির্ধারণ করে। আবার কখনো বিশ্বকেন্দ্রিক দিকনির্দেশনা নেয়।অর্থাৎ, বাইরের পরিবেশ দেখে দিক ঠিক করে।

আর আশ্চর্যের বিষয় হল, যখন তারা দ্রুত এই দুই অবস্থার মধ্যে পালা বদল করে, তখনই দেখা যায় সবচেয়ে নিখুঁত দলবদ্ধ গতি এবং ভারসাম্য।

এই ভারসাম্য প্রাণীদের একসঙ্গে দলবদ্ধভাবে চলা এবং পাশের সদস্যদের সঙ্গে ধাক্কা না-খাওয়া, দুটোই নিশ্চিত করে। এ যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করা এক উন্নত মস্তিষ্ক-নেটওয়ার্ক, যা কোনো কেন্দ্রীয় পরিচালকের প্রয়োজন ছাড়াই পুরো দলে সমন্বয় ঘটায়।

এই মস্তিষ্ক-নির্ভর নিয়মই এখন বিজ্ঞানীরা রোবটদের শেখাতে চাইছেন। সোয়ার্ম রোবোটিক্স-এ যদি ছোট ছোট রোবটরা এই রিং অ্যাট্রাকটার সার্কিটের মতো মস্তিষ্ক পায়,তবে তারা জি পি এস ছাড়াই একসঙ্গে কাজ করতে পারবে – একদম পাখিদের মতো।

গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য হলো, দীর্ঘদিন ধরে প্রাণীদের আচরণে যেসব নিয়মের অস্তিত্ব কল্পনা করা হতো, সেগুলো আসলে তাদের মস্তিষ্কের দিকনির্দেশনা বর্তনী থেকেই স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়। ফলে এই যুথবদ্ধতার মনোভাব শুধুমাত্র আচরণেরই নয়, বস্তুত স্নায়বিক প্রক্রিয়ারই এক চমৎকার প্রতিফলন।

 

সূত্র: Allocentric flocking by Mohammad Salahshour, Iain D. Couzin ,et.al; published in the journal Nature Communications,(13.10.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 + six =