প্রোক্লোরোকক্কাস : সমুদ্রের অদৃশ্য প্রাণশক্তি 

প্রোক্লোরোকক্কাস : সমুদ্রের অদৃশ্য প্রাণশক্তি 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সমুদ্রের গভীরে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে এক আণুবীক্ষণিক প্রাণ গোপনে বুনে চলেছে জীবনের জাল। এরা হলো প্রোক্লোরোকক্কাস নামক অতি ক্ষুদ্র নীল-সবুজ শৈবাল বা সায়ানোব্যাকটেরিয়া। এর ব্যাস প্রায় ৫০০ ন্যানোমিটার, যা একটি মানুষের চুলের প্রস্থের তুলনায় শতগুণ ছোট। অথচ এদের শক্তি অনন্ত। প্রতিদিন আমরা যে শ্বাস নিই , তাতেও বলা যায় এই অদৃশ্য প্রাণের অবদান রয়েছে।

প্রোক্লোরোকক্কাস পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের প্রায় ৫% উৎপন্ন করে। কোটি কোটি প্রাণের খাদ্য ও শক্তির উৎস হিসেবে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলের ভিত্তি গড়ে তোলে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে , সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা এই অদৃশ্য প্রাণীগুলোর জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।

যদিও ক্ষুদ্র, তবুও পৃথিবীর সূর্যালোকিত সমুদ্রপৃষ্ঠের ৭৫%-এর বেশি অংশে এদের উপস্থিতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা এই অণুজীবগুলো উষ্ণতর জলবায়ুতেও ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এদের বৃদ্ধি ১৯ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে সবচেয়ে ভালো হয়। ৩০ ডিগ্রির বেশি গরম হলে এদের বিভাজন ও বংশবৃদ্ধি দ্রুত কমতে শুরু করে।

গত দশ বছরে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষক ফ্রাঁসোয়া রিবালে ও তাঁর সহকর্মীরা প্রায় ১০০টি সমুদ্র অভিযানে ১,৫০,০০০ মাইল ভ্রমণ করেছেন এবং ৮০০ বিলিয়ন কোষ বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষ প্রযুক্তি সি ফ্লো সাইটোমিটার ব্যবহার করে তারা সরাসরি সমুদ্রের জলে প্রোক্লোরোকক্কাস কোষের সংখ্যা গুনেছেন। ফলাফল হতাশাজনক। যেখানে তাপমাত্রা বাড়ছে সেখানে প্রোক্লোরোকক্কাস কমে যাচ্ছে। যদি এই ধারা চলতে থাকে, তবে পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্রে এদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। বৈশ্বিকভাবে হারিয়ে যেতে পারে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।

জলবায়ুর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৭৫ বছরে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাগরাঞ্চলে গড় তাপমাত্রা এ সীমা ছাড়িয়ে যাবে। এর মানে, সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলে কমে যাবে খাদ্যের যোগান, কার্বন চক্রও বিপর্যস্ত হবে।

 

প্রোক্লোরোকক্কাসের পাশাপাশি আরেক সায়ানোব্যাকটেরিয়া সিনেকোকক্কাস উষ্ণ জলে টিকে থাকতে পারে, তবে এর বেশি পুষ্টির প্রয়োজন। তাই এটি প্রোক্লোরোকক্কাসের শূন্যতা পূরণ করতে পারবে কি না, তা অনিশ্চিত। আর সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণীরা কি এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে?এ প্রশ্নও উত্তরহীন।

কোটি কোটি বছর ধরে প্রোক্লোরোকক্কাস অতি-অল্প পুষ্টিতে বেঁচে থাকার দরুন অনেক জিন হারিয়ে ফেলেছে। তাই তারা উষ্ণ জলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অক্ষম। বিজ্ঞানীদের আশা, যদি এদের কোনো তাপসহিষ্ণু নতুন স্ট্রেন পাওয়া যায়, তবে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাতে পারে। সমুদ্রের এই অদৃশ্য ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো পৃথিবীর জলবায়ু ও খাদ্যশৃঙ্খলের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পাড়লে হয়তো এই অদৃশ্য রক্ষকরা দ্রুত বিলীন হয়ে যাবে, রেখে যাবে এক শূন্যতা, যা সমুদ্রের স্রোত থেকে শুরু করে আমাদের শ্বাস পর্যন্ত ছুঁয়ে যাবে। পৃথিবীর বাতাসও হারাবে তার অদৃশ্য রক্ষককে। সমুদ্রের ঢেউ থামবে না, কিন্তু তার অন্তর্গত প্রাণশক্তি নিঃশব্দে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাবে।

 

সূত্র: “Future ocean warming may cause large reductions in Prochlorococcus biomass and productivity” by François Ribalet, Stephanie Dutkiewicz, et.al; (8.09. 2025) , Nature Microbiology.

DOI: 10.1038/s41564-025-02106-4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + fifteen =