বিশ্বজুড়ে পুরুষদের মধ্যে যত ক্যান্সার হয় প্রোস্টেট ক্যান্সার তার শীর্ষে। এর মধ্যে এমন এক ধরন রয়েছে যা চিকিৎসার পরেও দ্রুত ফিরে আসে এবং মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তবে সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণা নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। তারা দেখিয়েছেন, দুটি ওষুধের সমন্বয় ওই ধরণের জিনগত ত্রুটিযুক্ত প্রোস্টেট ক্যান্সারের অগ্রগতিকে ধীর করতে পারে। এতদিন পর্যন্ত চিকিৎসকদের কাছে এটি প্রায় অপ্রতিরোধ্য ছিল। ৩২টি দেশে প্রায় ৭০০ জন পুরুষের উপর পরিচালিত এই তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল গবেষণায় অংশ নেয় ইউসিএলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এমন পুরুষদের বেছে নেওয়া হয়, যাদের শরীরে এইচআরআর (হোমোলগাস রিকম্বিনেশন রিপেয়ার) নামে পরিচিত কিছু জিনে ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি হলো বিআরসিএ–১ (BRCA1) ও বিআরসিএ–২ (BRCA2)। ক্যান্সার প্রতিরোধে এগুলির ভূমিকা প্রধান। জিনগুলিতে ত্রুটি থাকলে শরীরের কোষগুলির ডিএনএ মেরামতের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়,ফলে ক্যান্সার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। গবেষকরা এই শ্রেণির রোগীদের দুই দলে ভাগ করেন। একদলকে দেওয়া হয় নতুন ওষুধ-সমাহার, নিরাপারিব (একটি ‘পার্প ইনহিবিটার’) ও অ্যাবিরেটেরন নামের হরমোন-নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ একসঙ্গে । অপর দলকে দেওয়া হয় কেবল অ্যাবিরেটেরন ও প্লেসিবো (যা আসলে ওষুধ নয়)। ফলাফল বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়।যেসব রোগী এই নতুন ওষুধ-সমাহার পেয়েছেন,তাঁদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের অগ্রগতি প্রায় ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। আরও চমকপ্রদ হলো, যেসব রোগীর শরীরে বিআরসিএ জিনে ত্রুটি ছিল, তাঁদের ক্ষেত্রে এই হার অনেক বেশি (৪৮ শতাংশ)।
এই নতুন চিকিৎসায় উপসর্গ বাড়ার সময়ও প্রায় দ্বিগুণ বিলম্বিত হয়েছে। অর্থাৎ, রোগীরা তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ সময় ভালো থাকতে পেরেছেন। মোট মৃত্যুহারের ওপর প্রভাব নির্ধারণ করতে অবশ্য আরও কিছু সময় লাগবে। তবু গবেষকরা মনে করছেন এটি “চিকিৎসার দিক থেকে এক যুগান্তকারী ধাপ।” প্রোস্টেট ক্যান্সারের এই ধরনের সাধারণ চিকিৎসায় দ্রুত প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। প্রচলিত হরমোন চিকিৎসা বা কেমোথেরাপি প্রায়শই কিছুদিন পর ব্যর্থ হয়ে পড়ে। ফলে রোগীরা খুব দ্রুত শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যান। গবেষক দলের মতে, “এই জিন ত্রুটিযুক্ত প্রোস্টেট ক্যান্সার রোগীরা প্রায়ই চিকিৎসার পর অল্প সময়ের মধ্যেই পুনরায় আক্রান্ত হন। এই ওষুধের যুগল প্রয়োগ তাঁদের জন্য একেবারে নতুন পথ খুলে দিতে পারে।” এই পদ্ধতি আসলে এক ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা – অর্থাৎ রোগীর জিন অনুযায়ী থেরাপি নির্ধারণ। এর মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করার আগেই রোগীর জিন বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করা যাবে কারা এই ওষুধে সবচেয়ে বেশি উপকার পাবেন। ফলে ভবিষ্যতে প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসা আরও নির্ভুল ও রোগীভেদে আলাদা করে করা সম্ভব হবে। তবে গবেষণায় কিছু সতর্কতার দিকও উঠে এসেছে। নিরাপারিব ব্যবহারে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, যেমন রক্তশূন্যতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং মাঝে মাঝে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন। প্রায় এক চতুর্থাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রক্তসংক্রান্ত চিকিৎসা করতে হয়েছে।
তবুও গবেষকরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধটি সহনীয় ছিল এবং চিকিৎসা বন্ধ করতে হয়নি। মৃত্যুহারের পার্থক্যও এখনও পর্যন্ত পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তারা এখন দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছেন, যাতে বোঝা যায় এই ওষুধ শুধু ক্যান্সারের গতিই ধীর করে, নাকি মৃত্যুঝুঁকিও কমায়। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লক্ষ পুরুষ প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শুধু যুক্তরাজ্যেই প্রতি বছর পঞ্চান্ন হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়। গবেষকরা মনে করছেন, এই নতুন চিকিৎসা শুধু অগ্রসর পর্যায়ের রোগীদেরই নয়, প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি আগেভাগে জিন পরীক্ষা করে নেওয়া যায়। তারা বলেন, “সময় এসেছে ক্যান্সার চিকিৎসায় রোগীর জিনগত তথ্যকে প্রথম সারিতে আনার। এতে শুধু চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়বে না, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহারের ঝুঁকিও কমবে।” প্রোস্টেট ক্যান্সার পুরুষদের জীবনের অন্যতম বড় হুমকি। তবে এই গবেষণা জানাচ্ছে, বিজ্ঞান ক্রমে সেই হুমকিকে বশে আনতে পারছে। জিন-নির্ভর ওষুধ সমাহারের মাধ্যমে হয়তো ভবিষ্যতে এই ভয়ঙ্কর ক্যান্সারকে দীর্ঘ সময়ের জন্য থামিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এখনও লড়াই শেষ হয়নি, কিন্তু এক নতুন আশার দিগন্ত ইতিমধ্যেই উন্মোচিত হয়েছে।
সূত্র : “Niraparib and abiraterone acetate plus prednisone for HRR-deficient metastatic castration-sensitive prostate cancer: a randomized phase 3 trial” by Gerhardt Attard; et.el; 7 October 2025, Nature Medicine.
