
১৯৭৬ সালে, গুয়াতেমালায় শক্তিশালী ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। উত্তর আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান টেকটনিক প্লেটের সীমানা চিহ্নিতকারী, ভূ-ত্বকীয় ফাটল ‘মেটাগুয়াফল্ট’ বরাবর এই ভূমিকম্পে ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ যায় এবং ১.৫ কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। তীব্র ভূমিকম্পের ফলে ভূমিধস এবং পলি ভরা ঘোলা স্রোত সৃষ্টি হয়, যা হ্রদের তলদেশে পলির স্তর তৈরি করে। এই পলির স্তর, ভূমিকম্পের শক্তি এবং ভিন্ন অভিমুখে, ভূমি-কম্পনের বৈচিত্র্যময় তীব্রতা সম্পর্কে একটি ভূ-তাত্ত্বিক রেকর্ড হিসেবে কাজ করে। সাধারণত ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে যত দূরে যাওয়া যায় ততই পলির স্তর পাতলা হতে থাকে। কারণ, ভূমিকম্পের শক্তি দূরত্বের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু গুয়াতেমালার হ্রদগুলিতে, কম্পন সৃষ্ট ঘন পলির চিহ্ন সহ পাললিক স্তরগুলি, ভূ-তলের ফাটলের শেষে দেখা যায়। ‘মিসৌরি ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি’ র তত্ত্ববিদ, জোনাথন ওব্রিস্ট পারনার বলেছেন, “আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তাতে হ্রদগুলি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের সবচেয়ে কাছে ছিল। কিন্তু ফাটলপথের দূরে অবস্থিত হ্রদ্গুলিতে খুব পাতলা পলি জমা হয়েছে”। ভূ -পদার্থবিদ জেরেমি মাউরার বলছেন, “এই অস্বাভাবিক নমুনাটি ১৯৭৬ সালের ভূমিকম্পেরই ইঙ্গিত দেয়”। হ্রদের পলি কেন্দ্রস্থলে অতীতের ভূমিকম্পের প্রমাণ পাওয়াটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। একটি ভূমিকম্প কিভাবে তরঙ্গায়িত হয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, তার একটি নিদর্শন নিউজিল্যান্ড থেকে তুরস্ক পর্যন্ত পাওয়া গেছে! তবে যা অদেখাই থেকে যায়, তা হলো এই ফাটলের সাথে সম্পর্কিত হ্রদগুলি কোথায় অবস্থিত । এগুলি কি অক্ষের বাইরে, নাকি অক্ষের উপরেই অবস্থিত? ফাটলের উপর পলি জমার প্রভাবই বা কিরূপ হয়? ১৯৭৬ সালের ভূমিকম্পের পর যখন মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করে তখন তারা দেখতে পায়, মূল ফাটলপথ থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কুঁড়েঘরগুলি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, অথচ চ্যুতিরেখা বিস্তারের দিকে যে সমস্ত ঘরগুলি ছিল, সেগুলি প্রায় সবই ভেঙে পড়েছে। “আমি মনে করি এমন অনেক প্রমাণ আছে, যা ফাটলের দিকনির্দেশ করে। কেবল হ্রদের পলিতত্ত্বের দিকে তাকিয়েই আমরা এতকাল ভূমিকম্পের প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করতাম”। ২০০২ সালে, হ্রদ থেকে পাললিক স্তর পুনরুদ্ধার এবং বিশ্লেষণের কাজ শুরু হয়। ফার্নার জানান, “আমাদের মনে হল, কেবল ১৯৭৬ সালের ভূমিকম্পের দিকে তাকানোর উদ্দেশ্যেই নয়, বরং প্লেট সীমানার প্রাগৈতিহাসিক ভূকম্পের ইতিহাস সম্পর্কে আরো কিছু জানার এই এক আকর্ষণীয় সুযোগ। তবে এই সম্পর্কে আমরা এখনও খুবই কম জানি”। ১৯৭৬ সালের পর এই অঞ্চলে ভূকম্পবিদরা অল্প সময়ের জন্য ভিড় জমিয়েছিলেন। তবুও ৩৬ বছরের গৃহযুদ্ধের প্রভাব এবং যন্ত্রের অভাবে প্লেট সীমানা খুব একটা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। দেশের ভূকম্পন ঝুঁকির সম্পূর্ণতর চিত্র তৈরি করতে হ্রদের মতনই প্রাগৈতিহাসিক ভূকম্পের তথ্যও এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালে ওড্রিজ ও ফার্নারের দলটি হ্রদগুলি থেকে তাদের সবথেকে বড় পাললিক স্তর উদ্ধার করেন। যেখানে পলি স্তরের দৈর্ঘ্য , ৪০০০ বছর পুরানো হ্রদ- ইতিহাসের খোঁজ দেয়। তাদের প্রাথমিক বিশ্লেষণে, ১৮১৬ সালের কমপক্ষে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের একটি প্রমাণ মিলেছে।