ফুলগন্ধর দ্বিমুখী উপযোগিতা

ফুলগন্ধর দ্বিমুখী উপযোগিতা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৭ নভেম্বর, ২০২৫

পাহাড়ি তৃণভূমিতে ফুটে থাকা বনফুল শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, তাদের ঘ্রাণে লুকিয়ে আছে এক অনবদ্য রসায়ন। জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ম্যাক্সিমিলিয়ান হানুশ ও তাঁর সহযোগীরা অস্ট্রিয়ার উচ্চ প্রান্তরে ৩৯টি প্রজাতির বনফুল নিয়ে এক গবেষণা চালিয়েছেন। দেখা গেছে, যেসব ফুলের ঘ্রাণে রাসায়নিক বৈচিত্র্য বেশি, সেসব ফুলে বেশি প্রজাতির পরাগবাহক পোকামাকড় আসে, কিন্তু কম সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া বাস করে।
ফুলের ঘ্রাণ এক প্রকার রাসায়নিক সংকেত, যা বাতাসে বাষ্পীভূত উদবায়ী জৈব যৌগ দ্বারা তৈরি হয়। এই রাসায়নিকগুলো পরাগবাহকদের তো আকর্ষণ করেই, উপরন্তু ফুলের পৃষ্ঠে থাকা অণুজীবদেরও প্রভাবিত করে।
কেমোডাইভারসিটির অর্থ হল প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিপুল রাসায়নিক বৈচিত্র্য। প্রতিটি উদ্ভিদ, প্রাণী বা অণুজীব নিজের মতো রাসায়নিক তৈরি করে। কেউ পরাগবাহককে টানে, কেউ রোগ ঠেকায়। ফুলের ক্ষেত্রেও এই রাসায়নিক বৈচিত্র্য তাদের বেঁচে থাকা ও পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষকরা অস্ট্রিয়ার আল্পস পর্বতের তৃণভূমিতে ৩৯টি ফুলের প্রজাতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফুলের গন্ধর রাসায়নিক গঠন নিরূপণের পাশাপাশি, কোন কোন পোকা ফুলে আসে তাও নথিবদ্ধ করেন এবং ফুলের কোষকলায় থাকা ব্যাকটেরিয়াদের ডি এন এ বিশ্লেষণ করেন। তাঁরা দেখেন ফুলের আকৃতি বা উচ্চতা নয়, ঘ্রাণের রাসায়নিক বৈচিত্র্যই আসল প্রভাবক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঘ্রাণে বৈচিত্র্য বাড়লে পরাগবাহী প্রজাতির সংখ্যা ২.৪৯ গুণ বেড়েছে, অথচ ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি ০.৩৭ গুণে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, একদিকে পোকামাকড়ের উপস্থিতি বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি দমন হচ্ছে। কিছু ফুল যেন ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্গন্ধযুক্ত, পচা বা নোংরা গন্ধ ছড়ায় যাতে মাছি, গুবরে পোকা, বা অন্যান্য পচা জিনিসে আকৃষ্ট কীটপতঙ্গ তাদের দিকে ধেয়ে আসে। এসব পোকা ফুলের রেণু বহন করে নিয়ে যায় এক ফুল থেকে অন্য ফুলে, ফলে উদ্ভিদের প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পোকামাকড়রা ফুলে জীবাণু বহন করলেও, ফুলের নিজস্ব রাসায়নিক প্রতিরক্ষা সেই জীবাণুদের অনেকটাই দমন করে দেয়।
এই ফলাফল ফুল, কৃষি ও পরিবেশ—তিন দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাকৃতিকভাবে ঘ্রাণের বৈচিত্র্য বাড়ানো গেলে একদিকে পরাগায়ন বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে রোগজীবাণু সংক্রমণ কমবে। অর্থাৎ, প্রকৃতি নিজেই তার সুরক্ষা ও প্রজননের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে।
তবে গবেষকেরা বলেছেন, সব ধরনের ঘ্রাণ সব পোকাকে আকৃষ্ট করে না; কিছু ঘ্রাণ উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে সহায়তা করলেও কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে বাধা দেয়। ভবিষ্যতের গবেষণায় এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যই হতে পারে টেকসই কৃষি ও ফুলচাষের নতুন দিশা।
অতএব, ফুলের সুগন্ধ কেবল সুন্দর অনুভবের বিষয় নয়। এ প্রকৃতির এক প্রকার সূক্ষ্ম ভাষা, যা একদিকে মৌমাছি ও প্রজাপতিকে আকৃষ্ট করে ,আর অন্যদিকে ফুলকে রক্ষা করে অণুজীবের আক্রমণ থেকে।

সূত্র : Floral scent chemodiversity is associated with high floral visitor but low bacterial richness on flowers by Maximilian Hanusch, Alexander Keller,et.al; published in New Phytologist,(22.10.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 1 =