‘ফেজ’ ভাইরাসই ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির গুপ্তচর!

‘ফেজ’ ভাইরাসই ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির গুপ্তচর!

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৬ মে, ২০২৫

জানা যাচ্ছে, একসময়কার উপেক্ষিত ব্যাকটেরিওফেজ (সংক্ষেপে ফেজ), কতকগুলি ব্যাকটেরিয়া-গোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ জুড়ে বেশ ব্যাপকভাবে উপস্থিত। মোনাশ বায়োমেডিসিন ডিসকভারি ইনস্টিটিউটের ব্যাকটেরিয়াল সেল বায়োলজি ল্যাবের প্রধান অধ্যাপক ট্রেভর লিথগো ও তাঁর দল এই ভাইরাস সম্পর্কে আশ্চর্যজনক তথ্য দিচ্ছেন। এর মধ্যে কিছু ফেজ, তাদের জিনোমের প্রতিলিপি তৈরির জন্য ক্রোমোসোমের প্রান্তবর্তী টুপি আকারের টেলোমের কাঠামো ব্যবহার করে। তাই এগুলিকে ‘টেলোমের ফেজ’ও বলা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা উন্নত ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ দিয়ে এগুলি পরীক্ষা করেছেন। এরা ব্যাকটেরিয়া কোষের ভিতরে জড়ো হয়। অনেক ভাইরাল কণা প্রতিটি কোষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার জন্য বিশেষ কৌশলে সজ্জিত। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই টেলোমের ফেজগুলি তাদের সংক্রামিত পোষকদের হাতেই ‘টেলোসিন’ নামক অস্ত্র তুলে দিতে পারে। টেলোসিনে সজ্জিত এই ব্যাকটেরিয়া অপেক্ষাকৃত কম বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যাকটেরিয়াকে খতম করে দিতে পারে। এমনকি অ্যাণ্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াকেও।

এই আবিষ্কার ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি তৈরি করার আশা দেখায়। বিশেষ করে হাসপাতালের পরিবেশে, যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণু এক বিরাট সমস্যা। গবেষকরা এক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার পর্যায়ক্রম নির্ণয় করেন যা কখনও কখনও ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পাওয়া যায়। তাঁরা লক্ষ্য করেন, এদের মধ্যে ‘টেলোমের ফেজ’ প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বহু চেষ্টা করেও কিন্তু এদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যায়নি। “জীববিজ্ঞানের একটি সম্পূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল”, অধ্যাপক লিথগো বলেন। একসময় বিদঘুটে মনে হলেও, এই ভাইরাসগুলি কিন্তু খুবই সুলভ এবং ব্যাপক। এরা যেন গুপ্তচর। চুপিসাড়ে অনায়াসে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে অস্বাভাবিক উপায়ে প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে। এখন এদের মস্ত প্রভাবশালী বলে গণ্য করা হচ্ছে। কোন ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পাবে আর এবং কোনটি নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটা এরাই নির্ধারণ করে, বিশেষ করে যেখানে অনেক ধরণের ব্যাকটেরিয়া প্রতিযোগিতা করছে।
টেলোসিন নামক এই অধিবিষ, সম্ভাব্য ব্যাকটেরিয়ার ব্যবস্থাপনার আয়োজন করতে পারে। যেমন টেলোমের ফেজ-বাহী “ভালো” ব্যাকটেরিয়া প্রতিবেশী ‘ খারাপ’ ব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ‘ক্লেবসিয়েলা’কে মেরে ফেলবে। হাসপাতালে এ ধরণের সংক্রমণ এখনও একটি মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। টেলোমের ফেজগুলি এই ভয়ংকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
দেখা গেছে, এই ধরনের ফেজগুলি সম্ভবত কেবল এক ধরণের ক্লেবসিয়েলাতেই নয় , একাধিক সম্পর্কিত প্রজাতির মধ্যেও বিদ্যমান। জলের উৎস এবং অন্যান্য যেসব স্থানে এই ব্যাকটেরিয়ার বাস, সেখানে সাধারণভাবে এইসব ফেজ উপস্থিত থাকে। এগুলিকে কীভাবে ‘পরিচালনা’ বা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা যায়, তা জানার জন্য বাস্তবসম্মত মূল্যায়নের প্রয়োজন। টেলোসিনের কার্যকলাপ কতটা ব্যাপক হতে পারে তা পরীক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া প্রজন (স্ট্রেন) ব্যবহার করেন। প্রতিটি ধাপ বুঝতে পারলে ব্যাকটেরিয়া দমনের আরও সুনির্দিষ্ট পথ প্রশস্ত হতে পারে। তদন্তকারীরা নিশ্চিত যে ফেজগুলি বহন করলে সাধারণত ল্যাবে ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি ধীর হয়ে যায় না। এ এক সুষম সহাবস্থানের ইঙ্গিত, যেখানে ভাইরাসটি ব্যাকটেরিয়ার ভিতরেই “বেঁচে” থাকে। “আমরা এখন বুঝতে চাইছি পোষক কীভাবে অধিবিষ নিঃসরণ করে এবং কীভাবে তা অজান্তে ব্যাকটেরিয়া প্রতিবেশীদের মধ্যে ঢুকে পড়ে,” লিথগো ল্যাবরেটরির প্রথম লেখক স্যালি বায়ার্স বলেন। “ব্যাকটেরিয়ার জনসংখ্যার বিবর্তনে, ফেজ ভাইরাসগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারক শক্তি হতে পারে। পোষকদের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য দিয়ে সজ্জিত করার দিকে তাদের ঝোঁক, যা জীবাণু সম্প্রদায়ের মধ্যে সোরগোল তোলে। এই গতিশীলতাই হয়তো ব্যাখ্যা করবে কেন অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া প্রাধান্য পায় অথবা কীভাবে কিছু প্রজন কঠিন পরিবেশেও টিকে থাকে।
বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এই গবেষণার ফলাফল ‘ফেজ-অধিবিষ’ অংশীদারিত্ব নিয়ে গভীরতর গবেষণাকে অনুপ্রাণিত করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven + four =