ফোর্স ফিল্ডের রকমসকম

ফোর্স ফিল্ডের রকমসকম

Posted on ১২ আগষ্ট, ২০১৯

ক্রিকেট ফিল্ডে ক্রিকেট খেলা হয়, কিন্তু ফোর্স ফিল্ড মোটেই কোনও ক্রীড়াক্ষেত্র নয়। কী তবে? খেলা হয় না যখন সে নিয়ে আর মাথা ব্যথা করে লাভ কী? সত্যিই লাভ নেই। তবে কিছু মানুষের স্বভাব হল আপাতচক্ষে অলাভজনক বিষয় নিয়ে সিরিয়াস হয়ে মাথায় ভার্চুয়াল ভার চাপিয়ে শোকার্ত মুখে ঘুরে বেড়ানো। এখানেই তো অন্য সব প্রাণীর থেকে মানুষ আলাদা। ফোর্স ফিল্ডের কচকচিতে আসছি, তার আগে দেখে নেওয়া যাক ফোর্স অর্থাৎ বল ক’প্রকার?
চারভাগে ভাগ করা যায় যাবতীয় ফোর্সের ফ্যামিলিকে।
একঃ গ্রাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ

এ হল সেই ফোর্স যার জন্য আমরা স্বচ্ছন্দে পৃথিবীর মাটিতে চলেফিরে বেড়াতে পারি। হ্যাঁ, পাখিদের অবশ্য হাঁটবার দরকার পড়ে না, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ না থাকলে বায়ুমন্ডলের টিকিটি খুঁজে পাওয়া যেত না, ফলে পাখিদের ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানোর কায়দা অলীক কল্পনায় পর্যবসিত হত। গ্রাভিটির জন্য নক্ষত্রের চারদিকে গ্রহ-রা পাক খায়। মহাবিশ্বকে যে বন্ধন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, তার ভাল নাম হল অভিকর্ষ। অভিকর্ষ না থাকলে কী হত ভাবতে গেলে ফ্রিজ অবধি ঘামতে শুরু করবে, ডিপফ্রিজের ঘুপচি থেকে বেরবে ঘাম-কিউব। অভিকর্ষ না থাকলে আমরা এক হাজার মাইল/ঘন্টা গতিবেগ নিয়ে পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের দিকে উৎক্ষিপ্ত হতাম। এর পাল্লা বেজায় বড় হলেও তীব্রতা বা ক্ষমতা ভারী কম। গোটা পৃথিবী টানছে, তবু আমরা শুধুমাত্র ফুঁ দিয়ে একটা পাতাকে অভিকর্ষের বিপরীতে উড়িয়ে দিতে পারি।

দুইঃ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড

মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। মোবাইল নিয়ে মানুষ ঘুরছে। মেলায় নাগরদোলা ঘুরছে। বেশি পড়তে গিয়ে পড়ুয়াদের মাথা ঘুরছে। সব কিছুই তড়িৎ-এর অবদান(অল্প-বিস্তর অভিশাপ বললেও অত্যুক্তি হবে না)। মোদ্দা কথায় যা হল, ইলেকট্রনের প্রবাহ। আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ-ও নির্ভর করে থাকে ইলেকট্রিক সিগন্যালের উপর। তড়িৎপ্রবাহের কারণে যে ফিল্ড তৈরি হয় তা হল ইলেকট্রিক ফিল্ড এবং চুম্বক তার চারপাশে যে আকর্ষণ ক্ষেত্র তৈরি করে তা হল ম্যাগনেটিক ফিল্ড। এই দু’প্রকার ফিল্ডের মধ্যে কোনও আধান সে ক্যাটায়ন বা আনায়ন যাই আনা হোক সে একটা চাপ অনুভব করবে, সেটাই হল তড়িৎ বল বা চৌম্বক বল। মজার ঘটনা হল, তড়িৎ প্রবাহের কারণে ম্যাগনেটিক ফিল্ড-ও তৈরি হতে পারে। একে বলা হয়ে থাকে তড়িৎ চুম্বকত্ব, যার আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়ে গেছিলেন ফ্যারাডে। কিন্তু এ-দিয়ে আর যাই হোক ফোর্স ফিল্ড তৈরি অসম্ভব। ভয়ঙ্কর তাকত-ওয়ালা ইলেকট্রিক বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে যে-কোনও অন্তরক পদার্থ যেমন প্লাস্টিক হাসতে-হাসতে ভেদ করে যাবে। ইস্পাতের বুলেট ম্যাগনেটিক ফিল্ড আটকে দেবে? বেশ চালাও ফাইবারের গুলি।

তিনঃ স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স
পরমাণুর গঠন তো সবাই জানে। না জানলে কিচ্ছু ক্ষতি নেই। মনে-মনে ভাবা যাক একটা ফুটবল। ফুটবল মানেই গোলক। গোলকের কেন্দ্রে থাকে দু’ধরণের কণিকা, প্রোটন ও নিউট্রিন। আর পরিধি বরাবর ঘুরপাক খায় ইলেকট্রন-রা। বাকি জায়গা বেবাক ফাঁকা। আমরা যে নানান পদার্থ দেখতে পাই, তাদের ভিন্নতার কারণ ওই প্রোটন সংখ্যার পার্থক্য।
ভীষণ-ভীষণ গুরুত্বপূর্ন একটা ফোর্স হল এই স্ট্রং নিউক্লিয়ার। এর জন্য এই মহাবিশ্বে এত রকমের পদার্থ তৈরি হয়েছে। প্রোটন ও নিউট্রন একটা নিউক্লিয়াসের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে মারাত্মক বলশালী এই বলের হাতযশে। এই বলের কারণে নিজের খুশিমতো নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটন বার করে আনা যায় না। ক্ষমতাধর হলেও এই ফিল্ডের আওতার পরিধি বড়-ই কম। এর যত মুন্সিয়ানা কেবল নিউক্লিয়াসের মধ্যেই। ১ এর পর ১৫ টা শূন্য বসিয়ে সেটা দিয়ে ১-কে ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে তত মিটার হল এই স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সের ঘরবাড়ি। এর বাইরে মশাইয়ের কোনও জারিজুরি খাটে না।

চারঃ উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স
তেজস্ক্রিয়তা ঘটে এই ফোর্সের কারণে। কোনও মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা নিউট্রন ও প্রোটনের অনুপাত যদি 1.6 এর থেকে বেশি হয়ে যায়, তবে নিউট্রন ও প্রোটন নিজে থেকে ভেঙে যেতে শুরু করে। এই ভাঙনের ফলে উৎপন্ন হয় আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি। একেই বলা হয় তেজস্ক্রিয়তা। প্রোটন ভেঙে যাওয়ার অর্থ প্রোটন সংখ্যা কমে যাওয়া এবং তার অর্থ মৌলটা-ই বদলে যাওয়া। বদলে যাওয়ার পরেও যদি নিউট্রন-প্রোটন অনুপাত 1.6 এর নিচে না নামে তা হলে নতুন মৌল আবার ভেঙে যায়। এই ভাঙন চলতেই থাকে। এই প্রক্রিয়া থামে দস্তা-তে পৌঁছে। কিছু অ্যানালগ হাতঘড়িতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও স্পষ্ট সময় দেখা যায়, তার কৃতিত্ব এই তেজস্ক্রিয়তার। এইসব ঘড়ির কাঁটা ও অক্ষরে ব্যবহার করা হয়ে থাকে রেডিয়াম নামক তেজস্ক্রিয় পদার্থ।
ফোর্সফিল্ড কী?
এটা এক ধরণের অভেদ্য পাঁচিল, অদৃশ্য অথবা স্বচ্ছ। এটা আক্ষরিক অর্থেই অভেদ্য। ঘুষি, গুঁতো, পাটকেল-বৃষ্টি, কাঁদানে গ্যাস, বন্দুকের গুলি থেকে শুরু করে লেসার রশ্মি, কামানের গোলা অবধি রুখে দিতে সক্ষম ফোর্স ফিল্ড। তীর-ধনুক? থাক, ফোর্স ফিল্ডের সঙ্গে ওদের যুদ্ধে নামালে সে অপমানিত হবে।
এ দিয়ে কী করা যেতে পারে তা উল্লেখের আগেই খানিকটা আন্দাজ করা যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে এ-রকম একটা ফোর্স ফিল্ড অসম্ভব কার্যকরী নিখুঁত একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারে। সিনেমা বা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীতে এই ফোর্স ফিল্ড ব্যবহারের ভুঁড়িভুঁড়ি নজির আমরা দেখতে পাই।
সিনেমা, গল্প-সে-সব তো গালগল্প, পুরোদস্তুর কাল্পনিক। তা নিয়ে আবার এত খেজুর কীসের? গরু গাছে উঠে সয়াবিনের তরকারি খাচ্ছে সাপটে, এই দৃশ্য বাস্তবে সম্ভব করতে গেলে মাঠের নাম গাছ ও ঘাসের নাম সয়াবিন রাখতে হবে। পুরো বোকা বানানোর অভিসন্ধি। ঠিকই। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা আলোচনা করব। উল্লিখিত চার ধরণের ফোর্স কাজে লাগিয়ে কি সত্যিই ফোর্স ফিল্ড গঠন করা বাস্তবে সম্ভব? না। এই চারটি ফোর্স দিয়ে চলবে না। চারটি ফোর্সের গতিপ্রকৃতি দেখে আমরা বুঝতে পারছি যে তারা একক বা সম্মিলিতভাবে দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে পারবে না। বিজ্ঞানীরা আশায় আছেন পঞ্চম এক শক্তির যার হয়ত এখনো প্রকাশ ঘটেনি বা আমরা ধরতে পারিনি। সেই শক্তি হয়ত স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সের মতোই জোরালো এবং তার আওতা অন্তত কয়েক মিটার। আশা আপাতত তোলা থাক মনের কুলুঙ্গিতে। এখন দেখা যাক বাস্তবে কিভাবে ফোর্স ফিল্ড তৈরি করা যেতে পারে।
এই কাজে আমাদের অন্যতম উপকরণ হতে পারে প্লাজমা। এই রে! সেটা আবার কী? কাকিমা, মাসিমা শুনেছি। প্লাজমা? নতুন টাইপের কোনও সম্পর্ক বুঝি?
পদার্থের চতুর্থ অবস্থা হল প্লাজমা। এই প্লাজমা মহাবিশ্বের সর্বত্র দেখা যায়। আমরা ইতিমধ্যেই পরমাণু কী সে ব্যাপারে সম্যক অবহিত। পরমাণুর মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকট্রন থাকলে সেটা নিস্তরিত(যেহেতু প্রতিটি পরমাণুর ভেতরে প্রোটন ও ইলেক্ট্রনের সংখ্যা সমান ও তারা বিপরীত তড়িৎধর্মী), ফলে আকর্ষণ-বিকর্ষণ কোনও ধর্মই দেখায় না। কিন্তু ইলেকট্রন সংখ্যা হ্রাস বা বৃদ্ধি পেলে (অর্থাৎ নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা প্রোটনের থেকে ইলেক্ট্রনের সংখ্যা কমলে বা বাড়লে) পরমাণু বদলে তৈরি হয় আয়ন। পজিটিভ আয়নকে বলা হয় ক্যাটায়ন, যে অন্য মৌলের বাড়ি(পড়ুন কক্ষপথ) থেকে খাবলা মেরে ইলেকট্রন তুলে এনে নিজের খামতি পূরণ করতে আগ্রহী। নেগেটিভকে বলা হয় অ্যানায়ন, সে আবার উন্মুখ হয়ে থাকে নিজের মধ্যে অবস্থিত অতিরিক্ত ইলেকট্রনকে অন্যের ঘাড়ে (পড়ুন কক্ষপথে) চাপিয়ে দিতে। প্লাজমা আসলে এ-রকম আয়নিত পরমাণু দিয়ে গঠিত একটা গ্যাস। প্লাজমা-র প্রতিটা পরমাণু ইলেকট্রিকালি চার্জড। ফলে ইলেকট্রিক ও ম্যাগনেটিক ফিল্ড দ্বারা প্লাজমাকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্লাজমার সঙ্গে আমরা তেমন পরিচিত নই। কারণ পৃথিবীতে প্লাজমার উপস্থিতি বড্ড কম। সূর্য, বজ্রপাত এবং বর্তমানে প্লাজমা টিভির অভ্যন্তরে রয়েছে প্লাজমা। শুধু সূর্য নয়, প্রতিটা নক্ষত্রে রয়েছে প্লাজমা, এবং সে-কারনেই নক্ষত্র-রা ভয়ঙ্কর উত্তাপ সরবরাহ করতে পারে। কোনও গ্যাসকে অনেক বেশি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে পারলে প্লাজমা সৃষ্টি হয়, এতে তড়িতাহত কণা থাকার কারণে ইলেকট্রিক ও ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সাহায্যে ইচ্ছামতো আকার দেওয়া সম্ভব। পাতলা শিট-এর মতো আকৃতি দেওয়া গেলে তাকে বলা হয়ে থাকে প্লাজমা উইন্ডো। এই নিশ্ছিদ্র প্লাজমা উইন্ডো মারফত বাতাস থেকে শূন্যমাধ্যমকে আলাদা করা যেতে পারে। এর আবিষ্কর্তা পদার্থবিদ অ্যান্ডি হারসকোভিচ।
প্লাজমা উইন্ডোতে গ্যাস হিসেবে আর্গন ব্যবহার করা হলে তা নীলচে রং দেখায় (ঠিক যেমন বেন 10 কার্টুনে শিল্ড তৈরি করে থাকে বেন-এর দিদি জেন)। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই প্লাজমা উইন্ডো কি ফোর্সফিল্ড হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব? এটা কি কামানের গোলা আটকে দিতে পারবে? না, একা পারবে না। পারতে পারে অন্যদের সাহায্য নিয়ে। মিলিতভাবে কয়েকটা স্তর নিয়ে তৈরি করা যেতে পারে একটা অভেদ্য দেওয়াল। কেমন হওয়া উচিত এই স্তরগুলো?
বাইরের দিকের স্তরটা তৈরি হবে প্লাজমা উইন্ডো দিয়ে। দ্বিতীয় কিংবা মধ্যবর্তী স্তরে থাকবে লেসার বিম। লেসার এক বিশেষ ধরণের আলোক-রশ্মি। টর্চ থেকে বেরোনো আলো ক্রমশ এগোনোর সঙ্গে-সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সে-জন্য কিছুদূর পরেই টর্চের আলো আর দেখা যায় না(এই ঘটনার পোশাকি নাম ডাইভারজ করে যাওয়া)। কিন্তু লেসার ছড়িয়ে পড়ে না একটুও। সোজা লাইন ধরে এগিয়ে চলে। ফলে এর তীব্রতা অবিকল একই থেকে যায়। একটা লেসার রশ্মি পৃথিবী থেকে চাঁদ অবধি গিয়ে প্রতিফলিত হয়ে আবার এই নীল গ্রহে ফিরে আসতে পারে বিন্দুমাত্র শক্তির অপচয় না ঘটিয়ে। নির্দিষ্ট তীব্রতার লেসার দিয়ে মুহূর্তে পাথর, লোহা কেটে ফেলা যায়(বাড়িতে পরীক্ষা করে দেখার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা মানুষ, টারমিনেটরের রোবট নই। পেট ফুটো হয়ে গেলে স্পেশাল এফেক্ট দিয়ে জুড়ব নাকি!)। লেসার কী জানা গেল। এবার এগোই স্তরটা কেমন হবে সেই দিকে। এই স্তরে হাজার-হাজার অধিক তীব্রতার লেসার বিম জালকের মতো একে অপরের উপর বিছানো থাকবে। লেসার রশ্মি দিয়ে গঠিত হবে একটা ল্যাটিস স্ট্রাকচার, যার মধ্যে দিয়ে কোনও পদার্থ যেতে গেলেই সে প্রচন্ড উত্তাপের কবলে পড়ে পলকে বাষ্পীভূত হয়ে যাবে। কিন্তু সব পদার্থ যে আবার গ্যাসে পরিণত হয় না! যেমন পাথর। সে-ক্ষেত্রে তাদের রোখবার উপায় কী?
পরবর্তী স্তর-ও হবে একটি ল্যাটিস যা তৈরি হবে কার্বন ন্যানোটিউব দিয়ে। এই ন্যানোটিউব হল ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র টিউব যা একটা মাত্র কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি এবং এটি স্টিলের তুলনায় বহুগুন কঠিন। বর্তমানে সবথেকে ছোট যে কার্বন ন্যানোটিউব বানানো গেছে, তা 15 মিলিমিটার লম্বা। একটা মাত্র কার্বন পরমাণু দিয়ে গঠিত টিউব দিয়ে একটা ল্যাটিস তৈরি করা গেলে ভীষণ শক্তিশালী একটা চাদরের জন্ম হবে। এই স্তর অদৃশ্য কারণ কার্বন ন্যানোটিউব-রা পারমাণবিক আকৃতির। এ-প্রসঙ্গে ন্যানো-র মাপটা জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। ১ এর পিঠে ৯ টা শূন্য চাপিয়ে যে সংখ্যা পাব, সেটা দিয়ে ১-কে ভাগ করলে যে রাশি পাওয়া যায় সেটা হল ১ ন্যানোমিটার। এই ল্যাটিস পাথরের পাহাড়কে পর্যন্ত হেলায় আউট করে দেবে।
অর্থাৎ প্লাজমা উইন্ডো, লেসার পর্দা ও কার্বন ন্যানোটিউবের চাদর সম্মিলিতভাবে হয়ত একটা অদৃশ্য পাঁচিল তৈরি করবে যা দুর্ভেদ্য। ধাতুর তৈরি গুলি, পাথর মেশানো মর্টার, বিষাক্ত গ্যাস, কামানের গোলা ইত্যাদি আটকে দিতে পারবে এই দেওয়াল।
এই ত্রিস্তর দেওয়াল কিন্তু লেসার বিম থামিয়ে দিতে পারবে না। কারণ এই দেওয়াল স্বচ্ছ। স্বচ্ছ মাধ্যম আলোকে আটকাতে পারে না। প্রস্তাব আসতে পারে যে, স্রেফ কালো রঙের একটা প্লাস্টিক ঝুলিয়ে দিলেই তো হয়! না, নতুন এমন কোনও স্তর যোগ করা যাবে না যেটাকে খুব সহজেই লেসার গলিয়ে দিতে পারবে। লেসার বিমের আক্রমণকে রুখতে চাইলে এই ত্রিস্তরের মধ্যে-ই আরও একটা বৈশিষ্ট্য দরকার, তা হল ফটোক্রমাটিক্স-এর উন্নত সংস্করণ। ফটোক্রমাটিক্স ব্যবহার করা হয় সানগ্লাসে যেটা অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে এলেই নিজেকে কালো করে ফেলে। এটা তৈরি হয় এমন অণু দিয়ে যা কমপক্ষে দুটো অবস্থায় থাকতে সক্ষম(যেমন জলের তিনটে অবস্থা-বরফ,জল ও বাষ্প)। একটা অবস্থায় সেই অনু স্বচ্ছ কিন্তু অতিবেগুনি রশ্মির ধারেকাছে এলেই সে বদলে গিয়ে পুরোপুরি অস্বচ্ছ হয়ে উঠবে। ফলে আলো কোনোমতেই প্রতিসরণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে দেওয়াল পেরিয়ে আসতে পারবে না।
ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই কোনও দিন আমরা ন্যানোটেকনোলজির সাহায্যে এমন একটা পদার্থ তৈরি করতে পারব যেটা কার্বন ন্যানোটিউবের মতো শক্ত হবে এবং লেসার বিমের সংস্পর্শে আসা মাত্র নিজেকে অস্বচ্ছ করে তুলবে। ব্যস, আমাদের হাতে হাজির ফোর্স ফিল্ড। এটা দিয়ে যে-কোনও আক্রমন থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব। মা ভৈ!
আক্রমন ঠেকানোর জন্য ফোর্স ফিল্ড ব্যবহার আমরা শিখলাম। কিন্তু ফোর্স ফিল্ড কি শুধুই আত্মরক্ষার জন্য, আত্ম-উন্নয়নের জন্য নয়? মানবজন্ম কী শুধু মারামারি-র আর মার ঠেকানোর জন্য? বিজ্ঞান কখনই ধ্বংসের পথ দেখায় না। ধ্বংস ও বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক নয়, পরিপন্থী। কী ভাবে জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসতে পারে ফোর্স ফিল্ড? সে-দিকেও চট করে একবার ঘুরে আসা যাক। আলোর গতিতে ঘুরে আসতে না পারলেও কাছাকাছি স্পিডেই এগোব পাঠককে এই ভরসা দিতে পারি।
ফোর্স ফিল্ডের মাধ্যমে আমরা মাধ্যাকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারি। আমরা জানি, যে-কোনও চুম্বকের বিপরীত মেরু একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং সমমেরু বিকর্ষণ করে। এই বিকর্ষণ-বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে দ্রুতগতি এক ধরণের ট্রেন, যার পোশাকি নাম ম্যাগলেভ। এই ট্রেন ইস্পাতের লাইনের উপর দিয়ে চলে না, চলে স্রেফ বাতাসে ভেসে। ঘর্ষন বলের প্রভাব না থাকায় এই ট্রেন অন্যান্য ট্রেনের তুলনায় অনেকটা গতিতে চলতে পারে। চলার সময় ঝাঁকুনি-ও হয় না বললেই চলে। কিন্তু সমস্যা হল এই ধরণের ট্রেন তৈরিতে ব্যবহৃত যন্ত্রের খরচ। সুপারকন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহী ব্যবহার করতে পারলে খরচ অনেকটা কমানো সম্ভব। অতিপরিবাহী হল এমন একটা পদার্থ যার তাপমাত্রা -273K-এর কাছাকাছি নিয়ে এলে সে তার নিজস্ব রোধ হারিয়ে ফেলে (আমরা যেমন বেশি রেগে গেলে যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলি)। যুক্তিবাদি মানসিকতার মতোই রোধ কিন্তু ফালতু কিছু নয় বরং বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য। রোধ না থাকলে ওহম তার বিশ্ববন্দিত সূত্র আবিষ্কার করতে পারতেন না ঠিকই, তবে সেটার কারণে আমি রোধের ওকালতি করছি না। চারদিকে আমরা যে-সব ইলেকট্রিক কানেকশন দেখতে পাই, তার দেখি, যেগুলির জন্য ঘরে লাইট জ্বলে, পাখা চলে (উন্নত জাপানি বাড়িতে হয়ত রোবট অবধি চলে), সবই বানানো হয় প্রধানত তামা দিয়ে। কারণ তামা একই সঙ্গে তড়িতের সুপরিবাহী এবং সুলভ। তড়িৎ প্রবাহ ঘটা মানেই তাপের সৃষ্টি, যাকে সাধারনভাবে তড়িৎপ্রবাহের তাপীয় ফল বা জুল এফেক্ট বলা হয়ে থাকে। এই তাপ একটা নির্দিষ্ট মানের বেশি হলেই তার পুড়ে যাবে এবং বিঘ্ন ঘটবে প্রবাহে। রোধের অস্তিত্ব না থাকলে অত্যন্ত কম পরিমাণ তড়িৎ তার দিয়ে পাঠানো সম্ভব হত (পোড়ায় সমর্থন না দিতে), যে প্রবাহ আমাদের বর্তমান জীবনের চাহিদার সামান্য কিছু ভগ্নাংশ-ও পূরণ করতে পারত না। রোধ প্রবাহকে বাধা দেয়, ফলে পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থার সম্মুখীন না হয়েই তার যথেষ্ট পরিমাণ তড়িৎ সরবরাহ করতে পারে। আবার, এই রোধের কারণে যে-কোনও পরিবাহি মারফত তড়িৎ পরিবহনে অনেকটা শক্তি নষ্ট হয়। রোধের অনুপস্থিতিতে বহুদূর অবধি ইলেকট্রিক পাঠানো যাবে প্রায় বিনামূল্যে, কিন্তু সেখানে অবশ্যই তামা ব্যবহার করা যাবে না।। কিন্তু ট্রেন লাইন জুড়ে রাশি-রাশি অতিপরিবাহী বানাতে গেল ভয়ানক খরচ। -273K তাপমাত্রা তো আর ছেলেখেলা নয়। খরচ কমানোর জন্য খরচ বাড়ানো, ব্যাপারটা কি অদ্ভুত আর হাস্যকর তাই না? তা ছাড়া ওইভাবে ট্রেনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাত্রীদের পকেট থেকে যতটা টাকা বেরবে, সে টাকা দিয়ে লোকে প্লেনে চাপা-ই পছন্দ করবে।
তাই আমাদের প্রয়োজন এমন অতিপরিবাহী যা সাধারণ তাপমাত্রাতেই রোধ হারিয়ে ফেলবে। এই নিয়ে বর্তমানে প্রচুর গবেষণা চলছে। এখনও পর্যন্ত সাফল্য বলতে পাওয়া গেছে একটা পদার্থ যার নাম মার্কারি থেলিয়াম ব্যারিয়াম ক্যালসিয়াম কপার অক্সাইড, যা কিনা মোটামুটি -158K উষ্ণতায় অতিপরিবাহী ধর্ম দেখাচ্ছে।
কিন্তু ট্রেন ভাসছে কোন বিজ্ঞানের নিয়মে? নাকি অলৌকিককে বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে চালানোর ফন্দী এঁটেছি? আজ্ঞে ও-রকম কোনও দুরভিসন্ধি নেই। যা ঘটছে, তার সমস্তটাই নিখাদ বিজ্ঞান। ম্যাজিক মনে হতেই পারে, তাতে অপরাধ নেই। আরথার সি ক্লার্ক মশাই কবে বলে গেছেন যে অত্যাধুনিক বিজ্ঞানকে জাদুবিদ্যা ভাবার ভ্রম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
তড়িৎ পরিবহনকালে কোনও অতিপরিবাহী-র ঠিক উপরে একটা ম্যাগনেটকে রাখা হলে সেটা ভেসে থাকবে। সেকি? কেন?
তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যে কোনও চুম্বক আনা হলে তড়িৎপ্রবাহের দিক অনুযায়ী চুম্বকটি পরিবাহীর দিকে আকর্ষণ অনুভব করে কিংবা বিকর্ষণ। কিন্তু আমরা জেনেছি যে চুম্বক কেবলমাত্র চুম্বক দ্বারাই আকর্ষিত বা বিকর্ষীত হতে পারে। এ-ক্ষেত্রে কী হয়, ওই চুম্বক নিজের একটা প্রতিরূপ বানিয়ে ফেলে পরিবাহী-র মধ্যে( একদম সমতল দর্পণে গঠিত হওয়া প্রতিবিম্বের মতো)। প্রবাহের দিকের উপর নির্ভর করে সেই প্রতিরূপের মেরুদ্বয়ের অবস্থান স্থির হয়। ফলস্বরূপ পরিলক্ষিত হয় আকর্ষণ বা বিকর্ষণ। অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে প্রবাহের মান অনেক বেশি হওয়ায় গঠিত প্রতিরূপের ক্ষমতা-ও হয় দুর্দান্ত। অতিপরিবাহীতে তড়িৎপ্রবাহের অভিমুখ যদি এমনভাবে করা হয় যাতে তার মধ্যে গঠিত চুম্বকের প্রতিরূপের অবস্থান মূল চুম্বকের বিপরীতদিকে থাকে, তবে শক্তিশালী বিকর্ষণের প্রভাবে প্রকৃত চুম্বকটি ভেসে থাকতে বাধ্য হয়। একে বলা হয়ে থাকে মেইসনার এফেক্ট।
মেইসনার এফেক্ট কাজে লাগাতে পারলে আমাদের সামাজিক জীবনে রেনেসাঁ এসে পড়বে ঝট করে। রাস্তাঘাট যদি অতিপরিবাহী দিয়ে বানানো হয়, যেখানে প্রতিনিয়ত প্রায় নিখরচায় তড়িৎপ্রবাহ চলতে থাকবে এবং যান বাহনের টায়ারে কিংবা আমাদের পায়ের জুতোয় চুম্বক ভরা হয়, তবে আমরা ফ্রি-তে ভেসে-ভেসে টোই-টোই করে ঘুরে বেড়াতে পারব তা-ও আবার বিনাশ্রমে। ভাবা যায়!
এই মেইসনার এফেক্ট কার্যকরী একমাত্র চৌম্বক পদার্থের উপর, যেমন ধাতু। কিন্তু অতিপরিবাহী ব্যবহার করে অ-চৌম্বক পদার্থ-ও ভাসানো সম্ভব। অ-চৌম্বক পদার্থ বলতে ডায়াম্যাগনেট ও ফেরোম্যাগনেট। জল ডায়াম্যাগনেটিক পদার্থ। সমস্ত জীবিত প্রাণীর মধ্যেই জল মজুত। সুতরাং তাত্ত্বিক দিক থেকে চিন্তা করলে যাবতীয় জীবন্ত প্রানিকে উড্ডয়নের ক্ষমতা দেওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বাস্তবেই ব্যাঙের মতো ছোট প্রাণীকে ভাসিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এর জন্য ব্যবহার করতে হয়েছে 30 টেসলা শক্তি সম্পন্ন ম্যাগনেটিক ফিল্ড (যা কিনা পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের তুলনায় 30000 গুন বেশি)। কিন্তু মাত্রাছাড়া খরচ (যা আগেই বলেছি)-এর কারণে এর থেকে বেশি এগোনো যাচ্ছে না। যদি সাধারণ তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী বানানো সম্ভব হয়ে ওঠে তবে বড় বড় প্রাণীদের-ও অনায়াসে ভাসমান হয়ে চলাফেরা করার ক্ষমতা দেওয়া যাবে। স্লো-ভারসন সুপারম্যানের মতো উড়তে পারবে মানুষ। যদিও খুব বেশি উঁচুতে ওঠা যাবে না (তার জন্য তো রকেট আছে, ইসরো-র সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওরা সেই আবেদন খতিয়ে দেখবে নিশ্চয়ই!)।
ফোর্স ফিল্ড আমাদের জীবনযাত্রায় বিপ্লব নিয়ে আসতে সক্ষম। সব থেকে বড় কথা এই প্রযুক্তিতে পরিবেশ দূষিত হওয়ার তিলমাত্র-ও আশঙ্কা নেই। এই প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়ে উঠলে আকস্মিক দুর্ঘটনা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। মাঝ-আকাশে প্লেন বিকল হলে অল্প কোণে হেলানো বিশাল উচ্চতার ফোর্স ফিল্ড তৈরি করে প্লেনকে নামিয়ে আনতে পারব প্রাণহানি এড়িয়ে। পৃথিবীকে মুড়ে ফেলতে পারব, যাতে ভবিষ্যতে কোনও গ্রহানু আমাদের রক্তচক্ষু দেখাতে না পারে। পরিবহন ব্যবস্থায় কমে যাওয়া খরচের টাকা ব্যয় করতে পারব সমাজের উন্নতিতে। তা ছাড়া সমস্ত দেশ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ফোর্স ফিল্ড ব্যবহার করতে আরম্ভ করলে আক্রমণে কেউ কোনও ফল না পেয়ে ধীরে-ধীরে অনীহা দেখা দেবে যুদ্ধ-মনোভাবে। শান্তির বানী ও সমঝোতা বিশ্বজুড়ে যে শান্তি আনতে পারেনি, ফোর্স ফিল্ডের প্রাচীর মানবসভ্যতাকে উপহার দেবে সেই শান্তি। খনিজ তেল, কয়লা ইত্যদির উপর নির্ভরতা বহুলাংশে হ্রাস পাবে। প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ের পরিমাণ কমবে। আগামি পৃথিবী হয়ে উঠবে ক্রমশ দূষণ-বিহীন সবুজ এক গ্রহ।
আশা তো রাখাই যায়, তাই না?