বরফের নীচে লুকোনো হ্রদ

বরফের নীচে লুকোনো হ্রদ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে কয়েক মাইল জুড়ে চাপা পড়ে থাকা ভোস্টক (vostok)হ্রদ পৃথিবীর বৃহত্তম স্বাদু জলের হ্রদগুলির মধ্যে একটি। আকারে এটি আমেরিকার অন্টারিও হ্রদের সমান।অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে লুকানো ৪০০টিরও বেশি হ্রদের মধ্যে ভোস্টক হ্রদ সবচেয়ে বড়। এটি প্রায় ১৫০ মাইল লম্বা এবং ৩০ মাইল প্রশস্ত। এই হ্রদগুলি মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কারণ পৃথিবীর নিচের তাপে বরফের স্তর গলে যায়।একসময় বিশাল ভূপৃষ্ঠের হ্রদ হিসেবে পরিচিত ভস্টক হ্রদটি কমপক্ষে ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে মাটিচাপা পড়ে যায়। আবার কিছু অনুমান অনুযায়ী এটি প্রায় ২০ লক্ষ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে তুষারাবৃত ছিল। এত বছর ধরে আলো এবং বায়ুমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় হ্রদটিতে চরম অবস্থায় জীবন ধারণেসক্ষম এক্সট্রিমোফাইলস নামক অদ্ভুত জীবদের বাস। এই জীবগুলি ভোস্টক হ্রদের প্রচণ্ড ঠান্ডা, অন্ধকার এবং চাপের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। এটি একটি আকর্ষক বাস্তুতন্ত্র যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও চর্চা করছেন।ভোস্টক হ্রদটি দক্ষিণ মেরু প্রায় ৮০০ মাইল দূরে রাশিয়ার ভোস্টক নামক
গবেষণা কেন্দ্রের কাছে অবস্থিত। বিজ্ঞানীরা ১৯৫৭ সাল থেকে এই স্টেশনটিতে রয়েছেন । কিন্তু একজন রাশিয়ান ভূগোলবিদ পাইলট বিমান থেকে এর উপরে মসৃণ বরফ দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত তারা জানতেন না যে হ্রদটি সেখানে রয়েছে।১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানীরা অ্যান্টার্কটিকায় মাইলের পর মাইল বরফের নিচে লুকানো একটি হ্রদ খুঁজে পেতে উপগ্রহে বিশেষ রেডার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন। এই রেডার বরফের মধ্য দিয়ে দেখতে এবং জল সনাক্ত করতে পারে।বহু বছরের পরিকল্পনা এবং কাজের পর অবশেষে ২০১২ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের একটি দল বরফের মধ্য হ্রদে খননকার্য চালায়।ভোস্টক হ্রদটি দক্ষিণ প্রান্তে ০.৬ মাইল গভীর এবং উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তুলনামূলকভাবে অগভীর। বিজ্ঞানীরা হ্রদের তলদেশ বরাবর একটি শৈলশিরা আবিষ্কার করেছেন, যা গভীর এবং অগভীর অঞ্চলগুলিকে পৃথক করে। তাদের ধারণা, এই শৈলশিরায় প্রশান্ত মহাসাগরে পাওয়া বরফের মতো জলের নিচে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট থাকতে পারে। এটি হল সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত ফাটল যা ম্যাগমা দ্বারা উত্তপ্ত গরম জল নির্গত করে।এই হ্রদের জলের একমাত্র উৎস হল বরফের চাদর।এখানকার জল খুবই ঠান্ডা, প্রায় -৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।কিন্তু উপরের বরফের প্রচণ্ড চাপে এটি তরল অবস্থায় থাকে। এই চাপ জলের হিমাঙ্ক কমিয়ে দেয়, যা বরফে পরিণত হতে বাধা দেয়।এই হ্রদটি বিভিন্ন ধরণের জীবাণুর আবাসস্থল। যার মধ্যে কিছু সামুদ্রিক জীবও রয়েছে। বিজ্ঞানীরা হ্রদের উপরে অ্যাক্রিশন আইস(বরফ সঞ্চয় ) নামে পরিচিত হিমায়িত জলের একটি স্তরের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।পরীক্ষা করে তারা বরফের মধ্যে ৩,৫০০ টিরও বেশি জীবের ডিএনএ আবিষ্কার করেছেন , যার মধ্যে ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়াও রয়েছে যা সাধারণত মাছের পাচনতন্ত্রে পাওয়া যায়।

সালোকসংশ্লেষণ বাধা না পাওয়ায় এই জীবগুলি জলের খনিজ পদার্থ এবং পাথরের রাসায়নিক পদার্থ থেকে তাদের খাদ্য পায়। গবেষকরা মনে করেন এগুলি নিয়ে বিশদে গবেষণা করলে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা সহ অন্যান্য গ্রহ এবং চাঁদে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে সূত্র পাওয়া যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − ten =