বর্ষারণ্য সাফ, বিশাল ক্যাঙ্গারুর বিলুপ্তি

বর্ষারণ্য সাফ, বিশাল ক্যাঙ্গারুর বিলুপ্তি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

আদি অস্ট্রেলিয়ায় যখন মানুষের কোন চিহ্ন ছিল না, তখন সেটি বৃহদাকার ক্যাঙ্গারুতে পরিপূর্ণ ছিল। বিস্তৃত বর্ষারণ্য সু-উচ্চ সরীসৃপ, বৃহৎ পাখি এবং বিশাল মার্সুপিয়ালদের মতন স্তন্যপায়ীতে বাস্তুতন্ত্র সমৃদ্ধ ছিল। এই ভয়ংকর প্রাণীদের মধ্যে প্রোটেমনোডন নামক বিশাল ক্যাঙ্গারুরাও ছিল, বর্তমানে আর নেই। তবে এরা অদ্ভুত জীবনযাপন করতো। শুধু এই বর্ষারণ্যের এক ছোট অংশে চলাচল করতো। বর্ষারণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারাও ধ্বংস হয়ে যায়। ওলং গং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টোফার লরিকাইনেন গায়েতের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এদের সীমিত গতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বর্ষারণ্যের ক্ষতি, এই ক্যাঙ্গারুদের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার জন্য দায়ী। ক্যাঙ্গারুগুলির ওজন সাধারণত ১৭০ কিলোগ্রাম। এই যুক্তি অনুযায়ী ১১ বর্গ কিলোমিটারে, অন্তত একটি করে বৃহদাকার ক্যাঙ্গারু থাকা উচিত। দলটি জীবন্ত ম্যক্রোপড বা ক্যাঙ্গারু থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে, একটি রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করে দেখেন, সেই তুলনায় ১১.৬+ ৫.৬ বর্গ কিলোমিটারে একটি করে প্রোটেমনোডনের দেখা মিলছে। কিন্তু তারা মধ্য কুইন্সল্যান্ডের মাউন্ট এটনার চুনাপাথরের গুহা থেকে সংগৃহীত আটটি পৃথক প্রোটেমনোডনের জীবাশ্মর দাঁত পরীক্ষা করে দেখে অবাক করার মতো কিছু খুঁজে পান। এই প্রাচীন দাঁতগুলিতে খোদাই করা রাসায়নিক স্বাক্ষরগুলি ভিন্ন গল্প বলে। স্ট্রনশিয়াম আইসোটোপে কোন এলাকার ভূতত্ত্ব প্রতিফলিত হয় এবং একটি প্রাণীর খাদ্য সংগ্রহের তথ্য প্রকাশিত হয়। তা থেকে জানা যায় একটি সংকীর্ণ অঞ্চলের মধ্যেই বৃহদাকার ক্যাঙ্গারুগুলির খাবার পাওয়া যেত। মূলত মাউন্ট আলমা গঠনের স্থানীয় চুনাপাথরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অঞ্চলগুলিতেই এরা খাবার পেত। গবেষকরা লেজার অ্যাবলেশন ম্যাস স্পেকট্রোমেট্রি ব্যবহার করে এই আইসোটোপ বিশ্লেষণ করেন। এই কৌশলটি প্রতিটি প্রাণী কোথায় বাস করে এবং কোথা থেকে খাবার পায় তার চিহ্নবাহী । আশ্চর্যজনকভাবে বেশিরভাগ নমুনাই মাউন্ট এটনা গুহা গুলির কাছাকাছি এলাকা থেকে স্ট্রনশি য়ামের মাত্রার সাথে মিলে গেছে। WIGL8550 লেবেলযুক্ত এই দাঁতটি অ্যালটন ডাউনস ব্যাসাল্টের মতো কাছাকাছি গঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইসোটোপের স্বাক্ষর ধারণ করেছে। এটা পূর্ব বা দক্ষিণে ০.৯ মাইল অঞ্চল জুড়ে প্রাণীটির বিচরণের ইঙ্গিত দেয়। তবে গবেষকরা নিশ্চিত নন এই বিচরণের ঘটনা ক্যাঙ্গারুটির জীবদ্দশায় ঘটেছে নাকি মৃত্যুর পরে। হতেই পারে থাইলাকোলিও কার্নিফেক্স বা সারকো ফিলাস এর মতন প্রাণী ক্যাঙ্গারুটিকে মেরে মৃতদেহটিকে গুহায় টেনে নিয়ে যায়। অন্যান্য বেশিরভাগ নমুনায় দাঁতগুলির একটি উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীল ধরন লক্ষ্য করা গেছে। ক্যাঙ্গারুগুলি ব্যাপক এলাকা জুড়ে বিচরণ করত না। একটি ছোট বনের মধ্যে বাস করত এবং মারা যেত । গবেষণায় তাদের দীর্ঘ দূরত্ব ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পিছনে তিনটি প্রধান কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রথমটি পরিবেশগত। দু লক্ষ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাউন্ট এটনা অঞ্চল একটি স্থিতিশীল বর্ষারণ্যে বনের বাস্তুতন্ত্র বজায় রেখেছিল। এই সবুজ পরিবেশ প্রচুর খাদ্য এবং আশ্রয় জোগাতে পারতো। তাই বৃহদাকার ক্যাঙ্গারুদের বেঁচে থাকার জন্য বেশি দূরে যেতে হতো না। দ্বিতীয়টি, তাদের খাদ্যাভ্যাস জনিত কারণ। আধুনিক ক্যাঙ্গারুরা খোলা ভূখণ্ড জুড়ে ঘাস খায় কিন্তু প্রোটেমনোডন সম্ভবত দৌড়াদৌড়ি করত। এদের ছোট দাঁত এবং তার লম্বা অগ্রভাগ পাতা, ফল, নরম গাছগাছালি খাবার ইঙ্গিত দেয়, যেগুলি বর্ষারণ্যে সহজলভ্য। তৃতীয়ত, এদের গতিবিধি সম্পর্কিত কারণ। ক্যাঙ্গারুরা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে প্রোটেমনোডনদের চলা তার থেকে ভিন্ন ছিল। তারা মূলত চার পায়ে ভর দিয়ে চলাফেরা করত। তাদের লম্বাটে অগ্রভাগ এবং শক্তিশালী বাহু তাদের এই চতুষ্পদ গতির দিকে নিয়ে যায়। দীর্ঘ সময় এবং দীর্ঘ দূরত্ব লাফিয়ে লাফিয়ে চলার ক্ষমতা না থাকায় এই ক্যাঙ্গারুরা স্বাভাবিকভাবেই বর্ষার বেশিরভাগ সময়টা বসে কাটাতো। প্রায় দু লক্ষ আশি হাজার বছর আগে একসময় স্থিতিশীল এই বর্ষারণ্য হ্রাস পেতে শুরু করে। ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা ভূদৃশ্যকে শুষ্ক বনভূমিতে রূপান্তরিত করে। প্রোটেমনোডনরা যে ঘন গাছপালার উপর নির্ভর করত, তা বিলুপ্ত হতে শুরু করে। ক্যাঙ্গারুগুলি তাদের আবাসস্থলের সাথে এতটাই সংযুক্ত ছিল যে তারা মানিয়ে নিতে পারছিল না। অন্যদিকে, নতুন বর্ষারণ্য খুঁজে বার করার জন্য তারা স্থানান্তরিত হতেও পারছিল না। এই ক্যাঙ্গারুদের দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার শারীরিক ক্ষমতা এবং আচরণগত প্রবণতা দুয়ের ই অভাব ছিল। ফলস্বরূপ, তারা একটি পরিবেশগত ফাঁদে আটকে পড়ে। অথচ তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদগুলি তাদের চারপাশ থেকে অদৃশ্য হতে থাকে এক এক করে! অপটিক্যালি স্যিমুলেটেড লুমিনেসেন্স এবং ইউরেনিয়াম থোরিয়াম ডেটিং সহ নতুন কিছু তথ্য পদ্ধতি নিশ্চিত করেছে এরা ২,৮০,০০০ বছর থেকে ৩,৩০,০০০ বছর আগে বেঁচে ছিল। তাদের বিলুপ্তি বর্ষারণ্যের বাস্তুতন্ত্রের স্থানীয় পতনের সাথে মিলে যায়! সময়ের সাথে সাথে মাউন্ট এটনার বর্ষা র ণ্যের প্রাণিজগত শুষ্ক, উন্মুক্ত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রাণীদের স্থান দিতে শুরু করে। এই গবেষণার প্রভাব একক প্রজাতির বাইরেও বিস্তৃত। শরীরের আকারই এই সমস্ত প্রাণীগুলির ক্ষেত্রে বিলুপ্তির একমাত্র কারণ নয় বরং এক্ষেত্রে আবাসস্থলও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গবেষণা পরামর্শ দেয় যে কোন প্রাণীর পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস এবং চলাফেরার ধরনকেও বিলুপ্তির উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। অস্ট্রেলিয়ার মেগাফোর্নার, আফ্রিকান হাতি বা উত্তর আমেরিকার বাইসনের ক্ষেত্রে এই ধারণাটি ‘সর্বত্র প্রযোজ্য’ নয়। তবুও গায়েতে বলেন,”প্রথমে আমাদের মনে হয়েছিল এই বিশাল বিলুপ্ত ক্যাঙ্গারুদের আবাসস্থল অনেক বড় হবে। কিন্তু আধুনিক ক্যাঙ্গারুদের তথ্য ব্যবহার করে আমরা অবাক হয়েছি যে এরা ছোট পরিসরে বসবাস করত”। ডঃ স্কট হকনাল বলেন, “এই আইসোটোপিক কৌশলগুলি আমাদের তথ্য ক্ষেত্রকে ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করেছে। জীবাশ্মগুলি কোথায় বাস করত, কি খেত, কোথায় স্থানান্তরিত হয়েছিল, তার সমস্ত তথ্য জানা গেছে”। এই বৃহদাকার ক্যাঙ্গারুগুলি কোন নাটকীয় বা একক ঘটনায় বিলুপ্ত হয়নি বরং বর্ষা র ণ্যের ক্ষতিই,তাদের এই দুর্ভাগ্য ডেকে আনেl হতে শেখায়। কেন? অশনি সংকেতের মতন, তাদের আবাসস্থল সংকুচিত হলে, প্রথমে তারাই বিলুপ্ত হবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six + three =