
আলেক্জান্ডার ফন হামবোল্ড (১৭৬৯- ১৮৫৯) ছিলেন এক বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ, ভূগোলবিদ ও অনুসন্ধানকারী। তিনি প্রাকৃতিক বিশ্বকে সম্পূর্ণ আন্তঃসংযুক্ত রূপে দেখার নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেন। ২০১৯ সাল ছিল তার জন্মের ২৫০তম বার্ষিকী। ১৮৬৯ সালে তার ১০০তম জন্মবার্ষিকী বিশ্বজুড়ে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছিল।
হামবোল্ডের জীবন, বিজ্ঞান দর্শন এবং গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে অ্যান্ড্রিয়া উল্ফ “The Invention of Nature “ নামে একটি জীবনীমূলক বই লিখেছেন। বইটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে তাঁর জন্মভূমি প্রুশিয়ায় (বর্তমান জার্মানি) ও ইউরোপে তার শিক্ষাজীবন এবং প্রাথমিক ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে মূলত ১৭৯৯ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকা মহাদেশে ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে তাঁর বড় বড় অভিযানের বিবরণ রয়েছে। এই অভিযানে তিনি প্রকৃতি, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ করেন এবং আবহাওয়া, ভূ-গঠন ও প্রাণীবৈচিত্র্যের মধ্যে সম্পর্ক অনুধাবন করেন।
তৃতীয় অংশে, ইউরোপে ফিরে এসে তিনি তার অভিজ্ঞতাগুলিকে সংকলন করতে চেয়েছিলেন, তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধকালীন পরিবেশে তিনি অনেক বাধার সম্মুখীন হন। চতুর্থ ভাগে, তার রাশিয়া অভিযান (১৮২৯) এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে বক্তৃতা ও বই প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধারণের সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। পঞ্চম ও শেষ অংশে রয়েছে তার উত্তরাধিকার এবং প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে পরবর্তী বিজ্ঞানীদের ওপর তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা।হামবোল্ড প্রকৃতিকে একটি জীবনজালিকা হিসেবে দেখতেন। তিনি মনে করতেন, জীবজগৎ, ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু গভীরভাবে সম্পর্কিত। তার অভিনব উপস্থাপনার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। চিম্বোরাজো পর্বত (ইকুয়েডর) ঘিরে তাঁর উদ্ভিদবৈচিত্র্যের মানচিত্রে উচ্চতা, তাপমাত্রা ও উদ্ভিদবিন্যাসের পার্থক্যগুলো চিত্রিত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে গবেষণায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব অঞ্চলে উদ্ভিদ উপরের দিকে সরে গেছে।
তিনি ১৮০৭ সালে প্রকাশিত ‘উদ্ভিদের ভূগোল’ বইতে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার উদ্ভিদগুলোর মিল তুলে ধরেন এবং এই ধারণা উপস্থাপন করেন যে, একসময় এই মহাদেশগুলো সংযুক্ত ছিল (প্যানজিয়া)। এইসব ভূ-তাত্ত্বিক ও জীববৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পরবর্তী গবেষকদের জন্য ভিত্তি তৈরি করে দেয়, যেমন—চার্লস ডারউইন ও জোসেফ হুকার।
হামবোল্ড শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়েও চিন্তা করতেন। তিনি উপনিবেশবাদ, পরিবেশের ধ্বংসলীলা, দাসপ্রথা ও আদিবাসীদের ওপর অত্যাচারের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন কিভাবে স্থানীয় খাদ্যশস্যকে সরিয়ে দিয়ে আখ গাছের মতো রপ্তানি-ভিত্তিক ফসল চাষের পরিণামে ভূমির অবক্ষয়, জলস্তরের পতন এবং জীববৈচিত্র্যের হ্রাস ঘটেছে।
তিনি মানুষের তিনটি ক্রিয়াকলাপকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন- অরণ্য নিধন , অনিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থা এবং শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস। অ্যান্ড্রিয়া উল্ফ-এর মতে, হামবোল্ডই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি মানব-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন। তবে এই দাবির কিছুটা হয়তো অতিরঞ্জিত। তাঁর আগেও পিয়ের পোভ্রে প্রমুখ ব্যক্তি একই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তবে হামবোল্ড যে সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর ছিলেন, তা অনস্বীকার্য।হামবোল্ড শুধু বৈজ্ঞানিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও ছিলেন প্রভাবশালী। তার বক্তৃতা, প্রকাশনা ও মুক্ত শিক্ষার ধারণা সেই সময়ে ছিল বৈপ্লবিক। বার্লিনে তার প্রকাশ্য বক্তৃতাসভায় শত শত মানুষ অংশ নিতেন, যার মধ্যে অনেক নারীও ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল বিজ্ঞান সকলের জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি অনেক তরুণ বিজ্ঞানীকে আর্থিক ও বৌদ্ধিক সহায়তা দিতেন।
তার বৈশ্বিক বন্ধুত্ব, যেমন – ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ, তার কাজকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়। একবার তার সংগৃহীত নমুনা ফরাসি জাহাজে করে যাচ্ছিল। ইংরেজরা সেটি আটক করে। কিন্তু ইংরেজ ক্যাপ্টেন সেই নমুনাগুলি লন্ডনে হামবোল্ডের এক বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেন। এ থেকে বোঝা যায় তার প্রতি ইংরেজদের কতটা শ্রদ্ধা ছিল। আমাদের দেশে অক্ষয় কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) হামবোল্ড নিয়ে অনেক চর্চা করেছিলেন।
‘প্রকৃতির উদ্ভাবন’ বইটি হামবোল্ডের জীবন ও ভাবনাকে সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেছে। এটি জনপ্রিয় ঢঙে লেখা হলেও গবেষকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বইটি হামবোল্ডের কাজকে অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ না করলেও, তার জীবনের মাধ্যমে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সমাজের আন্তঃসংযোগকে প্রবলভাবে তুলে ধরে। এখান থেকে হামবোল্ডের যেসব গুণাবলী বিশেষভাবে প্রেরণাদায়ক বলে মনে হয় তা হলো-
1. প্রকৃতিকে গভীরভাবে জানার তৃষ্ণা।
2. প্রকৃতি ও সমাজের সম্পর্ক বিষয়ে বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি।
3. নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা উদারভাবে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা।
হামবোল্ড বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানবতাকেও মূল্য দিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংকটে আমরা যদি হামবোল্ডের মতো অন্তর্দৃষ্টি ও আন্তরিকতা নিয়ে গণতান্ত্রিক জ্ঞানবিনিময়ের চর্চা করি, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে পৃথিবী আরও বাসযোগ্য হতে পারে।
অ্যান্ড্রিয়া উল্ফ এই জীবনীগ্রন্থে দেখিয়েছেন, কিভাবে একজন মানুষ একাই বৈজ্ঞানিক চিন্তার গতিপথ বদলে দিতে পারেন।