বার্ধক্য প্রতিরোধী টি-সহায়ক কোষ 

বার্ধক্য প্রতিরোধী টি-সহায়ক কোষ 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

মানুষের জীবনচক্রে বার্ধক্য এক অনিবার্য প্রাকৃতিক সত্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কোষগুলির মেরামত ক্ষমতা হ্রাস পায়, রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়, আর শরীরে জমতে থাকে ক্ষতিগ্রস্ত বা অকেজো কোষ। কিন্তু সম্প্রতি ইসরায়েলের বেন-গুরিয়ন ইউনিভার্সিটি অব দ্য নেগেভ-এর বিজ্ঞানীরা বার্ধক্যকে বিলম্বিত করার এক নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন।

এ গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন প্রফেসর আলন মনসোনেগো। তাঁর দল আবিষ্কার করেছেন একটি বিশেষ ধরনের টি-সহায়ক কোষ। সে কোষ মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বাড়ে এবং পুরনো, অকেজো কোষগুলোকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করে দেয়। এরা যেন শরীরের একপ্রকার অভ্যন্তরীণ সাফাইকর্মী। আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও সামগ্রিক সুস্থতাকে এরা সঠিক ভারসাম্যে রাখে। এই কোষগুলো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাজের ধরন বদলায়, ফলে কোনো ব্যক্তির জৈবিক বয়স নির্ধারণে সাহায্য করে। জৈবিক বয়স কিন্ত সব সময় ক্যালেন্ডারের সঙ্গে না- ও মিলতে পারে।

আমাদের দেহে সহায়ক টি-লিম্ফোসাইট কোষ থাকলেও সেটা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। অনেকটা সেনাবাহিনীর কমান্ডারের মতো – যিনি নিজে যুদ্ধ না করে নির্দেশ দেন কারা, কবে, কীভাবে যুদ্ধ করবে। কিন্তু প্রফেসর মনসোনেগো ও তাঁর সহকর্মী প্রফেসর এস্তি ইয়েগার-লোটেম এমন এক উপশ্রেণির টি-সহায়ক কোষ শনাক্ত করেছেন, যা আগে কখনও বিজ্ঞানীদের নজরে পড়েনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কোষগুলো শরীরে জমতে থাকে। এদের তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে যায় যখন জাপানে শতাধিক বছর বয়সী লোকেদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ধরণের টি-সহায়ক কোষই তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। প্রফেসর মনসোনেগো বলেন যে এটাই এক বড়সড় ইঙ্গিত যে এই কোষগুলি হয়তো সারা জীবন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় সঠিকভাবে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য । প্রফেসর মনসোনেগোর গবেষণাগারে প্রফেসর ভ্যালেরি ক্রিজানোভস্কি (ওয়াইজম্যান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স)-র সহযোগিতায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ড. ইহেজকেল এলিয়াহু। এটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নেচার এজিং জার্নালে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কোষ বৃদ্ধ নিষ্ক্রিয় কোষে পরিণত হয়। তারা আর স্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হয়ে কাজ করতে পারে না এবং শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এই নতুন আবিষ্কৃত টি হেল্পার কোষগুলো সেই বার্ধক্যজনিত কোষগুলোকে ধ্বংস করে শরীরকে পরিশুদ্ধ রাখে।

ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই বিশেষ টি-হেল্পার কোষের সংখ্যা কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দিলে প্রাণীদের বার্ধক্য দ্রুত আসে এবং তাদের আয়ুষ্কালও কমে যায়। তার মানে এই কোষগুলো বার্ধক্য প্রতিরোধের প্রাকৃতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

প্রফেসর মনসোনেগোর মতে, ক্যালেন্ডারে লেখা বছরই বয়স বোঝার একমাত্র উপায় নয়, শরীরের জৈবিক বয়সই হল আসল সূচক। তাই ৩০ বছর বয়স থেকেই মানুষের দেহের এই কোষের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন, যাতে আগেভাগে বার্ধক্যের গতিপ্রকৃতি বোঝা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, অনেকের ধারণা,বার্ধক্য রোধ করতে হলে হয়তো অনাক্রম্যতন্ত্রের তারুণ্য বাড়াতে হবে। কিন্তু গবেষণা বলছে, এ ধারণা খুব সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে দরকার বয়সের সঙ্গে মানানসই বা ন্যূনতম ভারসাম্য বজায় রেখে সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম প্রতিরোধ ব্যবস্থা, তার অধিক কিছু নয়।

বিজ্ঞানীদের আশা, এই নতুন আবিষ্কার ভবিষ্যতে দীর্ঘায়ু বা সুস্থ জীবনকাল বাড়ানোর জন্য এক অনন্য দিকনির্দেশনা হয়ে উঠতে পারে।

মানবদেহের এই প্রাকৃতিক বার্ধক্য প্রতিরোধী সৈনিকরা হয়তো একদিন বার্ধক্যকে আর কপালের উপর ছেড়ে দেবে না, নিয়ে আসবে বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণে।

 

সূত্র: “CD4 T cells acquire Eomesodermin to modulate cellular senescence and aging” by Valery Krizhanovsky ,Alon Monsonego, et.al; (7.10. 2025), Nature Aging.

DOI: 10.1038/s43587-025-00953-8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen + twenty =