বিতর্কিত এক যুগপ্রবর্তকের বিদায়

বিতর্কিত এক যুগপ্রবর্তকের বিদায়

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৮ নভেম্বর, ২০২৫

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের অবসান ঘটল। ডিএনএ-র দুই প্যাঁচ ওয়ালা হেলিক্স গঠন আবিষ্কারের অন্যতম নায়ক, আমেরিকান জীববিজ্ঞানী জেমস ডি. ওয়াটসন প্রয়াত হয়েছেন। বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। ১৯৫৩ সালে সহগবেষক ফ্রান্সিস ক্রিক, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন ও মরিস উইলকিনস-এর সঙ্গে তিনি যে মডেল প্রকাশ করেছিলেন, তা জীববিজ্ঞানের ধারণাকে আমূল বদলে দেয়। অনেকের মতে ওটি ছিল বিশ শতকে জীববিজ্ঞানের মহত্তম আবিষ্কার। ওই মডেলই বিশ্বের সামনে প্রথমবার দেখায় যে ডিএনএ একটি দুই প্যাঁচের হেলিক্স গঠনবিশিষ্ট অণু। এটিই বংশগত তথ্যর ধারক ও বাহক।

ওয়াটসনের জন্ম ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও পাখি পর্যবেক্ষণে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি জীববিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। পরে স্নাতকোত্তর গবেষণায় মনোনিবেশ করেন জিন ও বংশগতি নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন জীববিজ্ঞান ও রসায়ন নতুন গতি পাচ্ছে, তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরি-তে ওয়াটসন ও ক্রিক একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের এক্স-রে বিচ্ছুরণ চিত্র বিশ্লেষণ করে তারা বুঝতে পারেন, ডিএনএ একটি প্যাঁচানো কাঠামোতে গঠিত। যেখানে দুটি পরিপূরক শৃঙ্খল একে অপরের সঙ্গে জড়ানো। এই কাঠামোই বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে জিনগত তথ্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পরিবাহিত হয়। “ডাবল হেলিক্স”-এর সেই মডেল শুধু বংশগতি নয়, আধুনিক জিন প্রকৌশল, ক্লোনিং, এমনকি মানব জিনোম প্রকল্পের ভিত্তি তৈরি করে দেয়। ১৯৬২ সালে ওয়াটসন, ক্রিক ও উইলকিনস একসঙ্গে জীবরসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

ওয়াটসন কেবল একজন গবেষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর। দীর্ঘদিন তিনি কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরি-র নেতৃত্ব দেন, যেখানে তিনি জিন ও ক্যান্সার গবেষণায় এক নতুন দিকের সূচনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ‘হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট’-এর সূচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লেখা আত্মজীবনী “দ্য ডাবল হেলিক্স” বিজ্ঞান লেখালেখির ইতিহাসে অসামান্য , যা গবেষণার মানবিক ও প্রতিযোগিতামূলক দিকটি পাঠকের সামনে উন্মোচন করে।

তবে বৈজ্ঞানিক গৌরবের পাশাপাশি ওয়াটসনের নাম জড়িয়ে আছে একাধিক বিতর্কের সঙ্গেও। ২০০৭ সালে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,“আমরা ধরে নিই যে সব জাতির বুদ্ধিমত্তা সমান। কিন্তু পরীক্ষাগুলো বলছে, তা নয়।“ এই মন্তব্য ব্যাপকভাবে বর্ণবিদ্বেষমূলক বলে সমালোচিত হয়। বিজ্ঞানী সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন ও সারস্বত মহল থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। এর জেরে ‘কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরি’ সম্মানসূচক সব পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়। পরবর্তী বছরগুলোতেও তিনি তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করেননি। বরং বলেন, “আমি যা ভেবেছি, সেটাই বলেছি।“ এই অবস্থান আরও বিতর্ক উস্কে দেয় এবং তাঁর উত্তরাধিকারকে জটিল করে তোলে।

 

ওয়াটসন আজও বিজ্ঞান জগতে এক অনিবার্য উপস্থিতি। তাঁর সাহসী কৌতূহল, যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান ও প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা জীববিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তবু তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, এক যুগান্তকারী আবিষ্কারকও ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা ও নৈতিকতার সংস্কার থেকে মুক্ত নয়। একদিকে তিনি ‘জীবনের নকশা’ উন্মোচনের স্থপতি। অন্যদিকে তাঁরই মন্তব্য মনে করিয়ে দেয়, বিজ্ঞানের সঙ্গে মানবিক সংবেদনশীলতা না থাকলে তা বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। জেমস ওয়াটসন প্রয়াত। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার – ডিএনএ-র দুই পাকের সিঁড়ি – আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের রহস্য উন্মোচনের অভিযান কত গভীর ও জটিল।

 

সূত্র: বিবিসি নিউজ, নভেম্বর ২০২৫, “James Watson: DNA scientist dies aged 97”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen + three =