বিশ্ব-ঘেরা তড়িৎক্ষেত্র

বিশ্ব-ঘেরা তড়িৎক্ষেত্র

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ মার্চ, ২০২৫

পৃথিবীকে ঘিরে যে-বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ ক্ষেত্রটি রয়েছে, নাসার এনডিওরেন্স মিশন এই প্রথম তা পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছে। ধনাত্মক আর ঋণাত্মক দুধরণের চার্জ সমন্বিত এই অ্যাম্বিপোলার বিদ্যুৎ ক্ষেত্রটি পৃথিবীর মহাকর্ষীয় ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বে মহাকাশে বায়ু কীভাবে ঢুকে পড়ে তা অনুসন্ধান করতে গিয়েই এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। ৫০ বছরেরও আগে বিজ্ঞানীরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু দিয়ে কীভাবে কণারা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ত্যাগ করে সে ব্যাপারে এই গ্রহব্যাপী বিদ্যুৎক্ষেত্রটির একটা ভূমিকা আছে। তাঁরা এটিকে “মেরু ঝঞ্ঝা” নাম দিয়েছিলেন। মেরিল্যান্ডের নাসা গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের প্রধান গবেষক গ্লিন কলিনসন জানিয়েছেন, বিশ শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকে মহাকাশযানগুলি পৃথিবীর মেরুর উপর বায়ুস্রোত শনাক্ত করে। ঠান্ডা কণাগুলি বাইরে থেকে কোনো উত্তাপ প্রয়োগ ছাড়াই কীকরে এমন শব্দোত্তর গতিতে চলে ভেবে তাঁরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল, ‘একটি অজানা শক্তি যেন কাজ করছে এক্ষেত্রে’। অনেকে এর মূলে সূর্যের প্রভাবের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু এক নাগাড়ে মেরু ঝঞ্ঝা দেখে মনে হয়েছিল, ওই ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। গবেষকরা যুক্তি দিয়েছিলেন, কোনো একটি সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ ক্ষেত্রই এই কাণ্ডটা ঘটাচ্ছে। তবে তখনকার যন্ত্রপাতি দিয়ে এটিকে শনাক্ত করা যায়নি। এনডিওরেন্স মিশন এবার এই প্রশ্নের পাকাপাকি উত্তর পাওয়ার জন্য কোমর বেঁধে নামে। মিশন টিম নরওয়ের সুমেরু অঞ্চলের স্বালবার্ড দ্বীপপুঞ্জকে পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়। ব্রিটেনের লিস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ বিজ্ঞানী সুজি ইম্বার বলেছেন, ‘ “স্বালবার্ড”-ই দুনিয়ার একমাত্র রকেট পাল্লাক্ষেত্র যেখান থেকে মেরু ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে উড়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় মাপজোক করা সম্ভব’। শক্তিযুক্ত কণারা যেসব পথরেখা ধরে পৃথিবীর সুরক্ষাস্তরগুলিকে ছাড়িয়ে যায়, সেখানে সেঁধিয়ে যাওয়া এখান থেকে সম্ভব। ২০২২ সালের ১১ মে, এনডিওরেন্স ৪৭৭.২৩ মাইল উচ্চতায় উঠে গিয়ে ১৯ মিনিট পরে গ্রীনল্যান্ড সাগরে ফিরে আসে। এই উড়ানের ৩২২ মাইল দীর্ঘ একটি পর্বে রকেটটিতে মাত্র ০.৫৫ ভোল্ট বিদ্যুৎ-বিভব ধরা পড়েছিল। কলিনসন বলেন, ‘এই পরিমাণ বিদ্যুৎ তো বলতে গেলে কিছুই নয় – একটা ঘড়ির ব্যাটারির মতো। কিন্তু মেরু ঝঞ্ঝাকে ব্যাখ্যা করবার জন্য ঠিক ওইটুকুই যথেষ্ট’। বহু দশক ধরে যা শনাক্ত করা যায়নি, বিশেষ ধরণের যন্ত্রপাতির সাহায্যে তা এবার সম্ভব হল। এই বহিঃস্রোতের মূল উপাদান হাইড্রোজেন। সদ্য-শনাক্ত এই ক্ষেত্রটি হাইড্রোজেনকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে ১০.৬ গুণ বেশি জোরালো বলে টেনে নেয়। ‘এই টান মাধ্যাকর্ষণ বলকে প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট। বস্তুত শব্দোত্তর গতিতে কণাদের মহাকাশে ঠেলে তুলে দেওয়ার পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট’, একথা বলেছেন এই প্রকল্পর বিজ্ঞানী আলেক্স গ্লোসার। শুধু হাইড্রোজেন নয়, অক্সিজেন আয়নগুলিও উঠে আসে। ওই সামান্য ভোল্টেজে ডুবে থাকে বলে তাদের ওজন অর্ধেক হয়ে যায়। তাই উল্লেখযোগ্য তাপ ছাড়াই আয়নগুলি চলতে থাকে। এই ব্যাপারটাই এতদিন বিজ্ঞানীদের হতভম্ব করে রাখত। সংগৃহীত তথ্য দেখিয়েছে, অনেক উচ্চতায় আয়নমণ্ডলের ঘনত্ব ২৭১% বাড়ে। এ থেকে মনে হয়, এই ক্ষীণ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রটি বেশ অনেকটা বায়ুকে ক্রমাগত পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাকাশে তুলে দেয়। এ যেন এক কনভেয়ার বেল্ট, যা আবহমণ্ডলটাকে মহাকাশে তুলে নিয়ে যায়। এই ঘটনাটাই গবেষকদের বিস্মিত করেছে। তাঁরা মনে করেন যে আহিত কণাগুলির এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বহুকাল আগে থেকে পৃথিবীর ঊর্ধাকাশের গঠন শান্তভাবে বদলে দিয়েছে। এই আবিষ্কার মঙ্গল কিংবা শুক্র গ্রহ প্রমুখ অন্যান্য গ্রহদের বায়ু-নিষ্ক্রমণের রহস্য উদ্ঘাটনেও সাহায্য করবে। হয়তো সৌরমণ্ডলের অন্যত্র প্রাণ থাকার সম্ভাবনা বিচারেও তা কাজে লাগবে। সম্প্রতি এই গবেষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে নেচার পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × two =