ভূ-গাঠনিক পাতের পুনরাবিষ্কার

ভূ-গাঠনিক পাতের পুনরাবিষ্কার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৭ আগষ্ট, ২০২৫

পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে হারিয়ে যাওয়া একটি ভূ-গাঠনিক পাত “পন্টাস” সম্প্রতি আবার আবিষ্কৃত হয়েছে। জাপান থেকে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত পৃথিবীর অন্যতম জটিল ভূ-গাঠনিকভাবে সক্রিয় অঞ্চলে, ভূতাত্ত্বিকেরা এই হারিয়ে যাওয়া পাতের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। অনেকেই মনে করেছিলেন পাতটি চিরতরে হারিয়ে গেছে।
প্রায় ১৬ কোটি বছর আগে এটি প্রশান্ত মহাসাগরের এক-চতুর্থাংশ অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। পরে এটি অধঃগমনের মাধ্যমে ভূত্বকের নীচে বিলীন হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়েছিল।

প্রায় এক দশক আগে বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভস্থ ভূ- কম্পন তরঙ্গের অস্বাভাবিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন। এই তরঙ্গগুলো যখন পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ গুরুমন্ডল দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন কোনো ধাতব পরিবর্তন বা তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে দিক বা গতি পরিবর্তন করে। এই বিচ্যুতিগুলো হয়তো মূলত পুরোনো পাতের অবশিষ্টাংশ থেকে সৃষ্ট। সেই সূত্র ধরেই বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করতে থাকেন যে, প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অংশে একটি বৃহৎ অবনমিত পাত একসময় বিদ্যমান ছিল।
নেদারল্যান্ডসের ইউট্রেখট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ সুজানা ভান ডে লাগেমাট এবং তার সহকর্মীরা এই হারিয়ে যাওয়া পাতের টুকরোগুলো খুঁজে বের করে পাতটির সম্পূর্ণ গঠন পুনর্নির্মাণ করেন। তারা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সমুদ্রতলের শিলার নমুনা সংগ্রহ করেন। পরীক্ষার মাধ্যমে তারা প্রমাণ পান যে এই টুকরাগুলো আসলে উত্তর দিক থেকে এসেছে। এরা পূর্বপরিচিত কোনো পাতের অংশ নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন পাত— ‘পন্টাস’।
এই পাতটির বয়স প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বছর। অধঃগমনের মাধ্যমে এটি ধীরে ধীরে পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এর ধ্বংসের ফলে শুধু নিম্নগামী পাতটিই নয়, উপরিস্তরের পাতটিও হারিয়ে যায় — যা খুবই বিরল ঘটনা। এর ফলে পাতটির অস্তিত্বের অনেক প্রমাণ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে – জাপান, বোর্নিও, ফিলিপিনস, নিউ গিনি ও নিউজিল্যান্ডে।
এই পাতটি দুটি পাতের সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল বলে ধরা হয়। অর্থাৎ, এটি প্রাচীন প্যান্থালাসা (সমগ্র মহাসাগরীয় ভূ-ত্বকের সমষ্টি) ও টেথিস মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল। এই এলাকায় প্রচুর পাত নিমজ্জনের অধঃগমন অঞ্চল ছিল, যেগুলি ভূ-গঠনের ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রাখতে পারেনি।

লাগেমাট এবং তার দল ভূ-চৌম্বকীয় তথ্য, পর্বতমালার গঠন, এবং ভূ-তরঙ্গের মডেলিংয়ের সাহায্যে পাতটির অস্তিত্ব ও গতিপথ নির্ধারণ করেছেন। তারা দেখতে পান যে জাপান থেকে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ঐক্যবদ্ধ পাত প্রণালীর মধ্যে পন্টাস ছিল কেন্দ্রীয় উপাদান। বিশেষ করে, বোর্নিও অঞ্চলের ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণে কিছু প্রাচীন শিলা আবিষ্কৃত হয় যেগুলো এ ধারণাকে সমর্থন করে।
পন্টাস প্লেটটি একসময় প্রায় ১৫ মিলিয়ন বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল, যা আজকের প্রশান্ত মহাসাগরের এক-চতুর্থাংশ। এটি ছিল এক সমন্বিত নিমজ্জন প্রণালীর অংশ যা প্রায় ১৫ কোটি বছর স্থায়ী ছিল। এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে ভূ- গাঠনিক ক্রিয়া শুধু স্থানীয় প্রভাবই ফেলেনি, বৈশ্বিক পরিবর্তনেরও ইঙ্গিতবাহী। আরও জানা যায়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাতের চলাচলের দিক পরিবর্তনের একটি বড় কারণ ছিল একটি উপকূলবর্তী অঞ্চলের ধ্বংসপ্রাপ্রাপ্তি। বিশেষ করে হাওয়াই-এম্পেরর বেন্ড-এর। এটি হলো সমুদ্রের তলায় অবস্থিত আগ্নেয়গিরির একটি লম্বা লাইন, যেখানে মাঝখানে হঠাৎ করে দিক পরিবর্তন বা বাঁক দেখা যায়। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, এক সময় পৃথিবীর ভূ-ত্বকীয় পাতের গতি বদলে গিয়েছিল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাতের নিমজ্জনের কারণে নয়, বরং প্রশান্ত ও অস্ট্রেলিয়ান পাতের গতি পরিবর্তনের ফলে এটা ঘটেছিল।
প্রায় ২০ মিলিয়ন বছর আগে পন্টাসের শেষ চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। আজকের দিনে এই পাতের অবশেষ পাওয়া যায় ফিলিপিনসের পালাওয়ান অঞ্চল, দক্ষিণ চীন সাগর এবং বোর্নিও দ্বীপে। এই খণ্ডিত পাতের অংশ দেখেই বিজ্ঞানীরা পাতটির বিস্তৃতি ও ইতিহাস শনাক্ত করেন।
পন্টাসের আবিষ্কার কেবল এক হারানো পাতের পুনরাবিষ্কার নয়, বরং এটি পৃথিবীর ইতিহাস, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং খনিজের বিতরণ সম্পর্কেও এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সুচক। এটি প্রমাণ করে ভূ-গাঠনিক গতিবিধি কিভাবে বৈশ্বিক স্কেলে ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ গঠনে প্রভাব ফেলে। এই আবিষ্কার পুরোনো ভূ-গাঠনিক মডেলগুলোকে নিয়েও প্রশ্ন তোলে ।
সুজানা ভান ডে লাগেমাটের গবেষণাটি গন্ডোয়ানা রিসার্চ নামক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণার মাধ্যমে তিনি শুধু একটি হারিয়ে যাওয়া পাতই আবিষ্কার করেননি, ভূতত্ত্বের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তার কাজ বিশ্বব্যাপী ভূ-বিজ্ঞানীদের নতুনপথ দেখাবে।

পন্টাস পাতের পুনরাবিষ্কার আবার প্রমাণ করল —হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস কখনও সত্যিই হারিয়ে যায় না, তা ধরা দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে সচেতন কোনো চোখের কাছে।

সূত্র: Lost Pacific tectonic plate named Pontus found after 160 million years ; The Brighter Side of News (02.07.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × five =