ভূমিকম্পে জঙ্গলের পুনর্জীবন হয়!

ভূমিকম্পে জঙ্গলের পুনর্জীবন হয়!

সুদীপ পাকড়াশি
Posted on ৩১ অক্টোবর, ২০২১

আপাতদৃষ্টিতে ভূমিকম্পের কোনও ইতিবাচক দিক আছে বলে মনে হয় না। ভূমিকম্প মানে তো শুধু ধ্বংসলীলা। কিন্তু বিজ্ঞানীদের একাংশের পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছে, ভূমিকম্পেরও ইতিবাচক দিক আছে! দীর্ঘমেয়াদী না হলেও স্বল্পমেয়াদী উপকার ভূমিকম্প করে! সেটা মানুষের নয়, উদ্ভিদের, গাছপালার। এককথায় ভূমিকম্পে পুনর্জীবন পায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া জঙ্গল! অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী, ইরিনা পানিউশিকনা। তিনি নিজে উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন। তবু, তার পর্যবেক্ষণ খুব তাৎপর্যপূর্ণ। জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পর যেমন গাছপালার শিকড় উপড়ে যায়, একইসঙ্গে, সমুদ্র বা নদীর জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপড়ে যাওয়া শিকড়গুলিতে প্রচুর পরিমাণে আবার জলের প্রবেশ ঘটে এবং তার ফলে আবার নতুনভাবে প্রাণের সঞ্চার হয় উদ্ভিদের, নতুনভাবে সৃষ্টি হয় নতুন গাছপালার। ইরিনার মতে উদ্ভিদের ভেতরে যে কোষগুলো থাকে, সেগুলোর ভেতর জলের প্রবেশে দ্রুত অন্য উদ্ভিদগুলোর মধ্যেও দ্রুত সেটা ছড়িয়ে পড়ে আর প্রাণের সঞ্চার ঘটে। সৃষ্টি হয় নতুন জঙ্গলের!
পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোলজিস্ট (জলবিদ্যাবিদ) ক্রিশ্চিয়ান মোর একসময় মানতে চাইতেন না যে, ভূমিকম্পের সঙ্গে আদৌ গাছের বৃদ্ধির কোনও সম্পর্ক আছে বলে। কিন্তু তার জীবনে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা তাকে এই গবেষণায় আগ্রহী করে তোলে এবং তিনি মানতে শেখেন যে, সত্যিই এই দুয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। মোর তখন চিলিতে। সালটা ২০১০। সেডিমেন্ট ট্রান্সপোর্ট নিয়ে পড়াশুনো করছেন। সে সময় চিলির মলে বিরাট এক ভূমিকম্প হয়েছিল। রিখটার স্কেলে ম্যাগনিটিউড ছিল ৮.৮! একটা কাঠের বাড়িতে থাকতেন মোর। মধ্যরাতের ওই ভূমিকম্পে চুরমার হয়ে গিয়েছিল বাড়িটা। মোর কোনওক্রমে দরজার ফ্রেমের মধ্যে আটকে ছিলেন। ভূমিকম্প এবং তারপর সুনামিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল চিলির উপকূলবর্তী অঞ্চল। মারা গিয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন অন্তত ২০ লক্ষ মানুষ।
ভূমিকম্পের পর মোর এবং তার সঙ্গে আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী একটা নদী উপত্যকায় গিয়ে দেখেছিলেন প্রচন্ড গতিতে জলের স্রোত বইছে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ভূমিকম্পের ধাক্কায় নীচের মাটি নরম হয়ে গিয়েছে। তাই নদীর জল প্রচন্ড তোড়ে ঢুকছে উপত্যকায়। সেই সময় মোরের প্রথমবার মনে হয় তাহলে ভূমিকম্পের একটা ইতিবাচক প্রতিফলনও থাকতে পারে। আর একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ৬টা মন্টেরি পাইন গাছের কান্ড থেকে দু’ডজন কাঠের প্লাগ ওই উপত্যকায়, যেখানে প্রচন্ড তোড়ে জল ঢুকছে, সেখানে পুঁতে দিয়ে এসেছিলেন। এক একটা প্লাগ পেন্সিলের চেয়েও সরু ছিল। তার বেশ কিছুদিন পর জার্মানিতে তার গবেষণাগারে ফিরে সরু থেকে মোটা হয়ে যাওয়া ওই কাঠের প্লাগ নিয়ে মাইক্রোস্কোপের সামনে বসেছিলেন মোর। তখন তার চোখের সামনে পরিষ্কার, অবাধে জল পাওয়ার পর কীভাবে ওই পেন্সিলের চেয়েও সরু সরু কাঠের প্লাগগুলোর আকার ও আকৃতি বদলে গিয়েছে! পরবর্তীকালে, চিলির মলে বিধ্বংসী ওই ভূমিকম্পের পর বিজ্ঞানীরা দেখেছেন নদী উপত্যকা ও চিলির সমুদ্রতটের পাশের অঞ্চলগুলোতে থাকা গাছপালার বৃদ্ধি। চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মত বৃদ্ধি না হলেও গাছগুলো নজরকাড়ার মত দৈর্ঘ্যে বেড়েছিল।
এই উদাহরণ শুধু চিলি নয়, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনেও রয়েছে! সুনামিতে আন্দামানের মত সুন্দরবনেও ক্ষতি কম হয় নি। ‘আয়লা’ ঘূর্ণিঝড়েও প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। তারপর, এখনও পর্যন্ত কতটাই বা সংস্কার করা হয়েছে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের? কিন্তু যা পুনর্গঠন হয়েছে তার অধিকাংশ প্রকৃতিই করেছে! যেভাবে ২০১০-এর ভূমিকম্প করেছিলো চিলিতে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × five =