ভূমিকম্পের গর্জন আর ফিসফিসানি

ভূমিকম্পের গর্জন আর ফিসফিসানি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১২ জুলাই, ২০২৫

সম্প্রতি গবেষকরা জাপানের নানকাই অধোগমন অঞ্চলের ফাটল বরাবর এক বিরল ধরণের ধীরগতির ভূমিকম্প শনাক্ত করেছেন। এটি সাধারণ ভূমিকম্পের মতো হঠাৎ আঘাত হানে না, বরং সপ্তাহ জুড়ে মাত্র কয়েক মিলিমিটার মাত্রায় ধীরে ধীরে কম্পন স্থানান্তরিত হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক নীচে, যেখানে ফিলিপিন মহাসাগরীয় পাতটি জাপানের নীচে সরে যায়, তখন এই ঘটনাটি ঘটে। ২০১৫ সালে প্রথম এমন ধীরগতির ধস ধরা পড়ে, যা ২০২০ সালে আবারও ঘটে। প্রতিবারই ফাটলের প্রায় ২০ মাইল অংশ ধীরে ধীরে আলগা হয়ে গিয়ে জাপানের কিই উপদ্বীপ থেকে সমুদ্রগহ্বরের দিকে এগিয়ে যায়। জাপানের সমুদ্রগর্ভে স্থাপিত বোরহোল অবজারভেটরি বা গভীর পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো এ ঘটনাটি শনাক্ত করে। স্থলভাগের সেন্সর বা জিপিএস এসব সূক্ষ্ম পরিবর্তন বুঝতে পারে না। এই উচ্চ-প্রযুক্তির বোরহোল সেন্সরগুলোর মাধ্যমে তরল চাপ, ভূমির চাপ শনাক্ত করা সম্ভব হয়, যা বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বুঝতে সহায়ক।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধীর গতির ভূমিকম্প প্রধানত সেইসব এলাকায় ঘটছে, যেখানে ভূগর্ভস্থ তরলের চাপ বেশি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই অতিরিক্ত তরলের চাপ ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ফাটলে ঘর্ষণ কমিয়ে দেয়, ফলে হঠাৎ বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প না ঘটিয়ে ফাটলগুলি ধীরে ধীরে সরে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ফাটলের এই উপরের স্তর নিয়মিত এভাবে ধীরে ধীরে শক্তি ছেড়ে দেয়, তবে বড় সুনামির সম্ভাবনা কিছুটা কমতে পারে। আর যদি গভীর স্তরগুলো শক্তি জমিয়ে রাখে, তাহলে তা বড় ধরনের ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটানোর ঝুঁকি তৈরি করে , যা থেকে মারাত্মক সুনামির সৃষ্টি হয়। যেমনটি ১৯৪৬ সালে নানকাই অঞ্চলে ঘটেছিল, যেখানে ১,৩০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

পৃথিবীর অন্যান্য বিপজ্জনক অঞ্চল, যেমন প্রশান্ত মহাসাগরের ক্যাসকেডিয়া অধোগমন অঞ্চল, চিলি, ইন্দোনেশিয়াতেও একই ধরনের ধীরগতির ভূমিকম্পের নজরদারি জরুরি বলে গবেষকরা মনে করেন। এই তথ্য সুনামি পূর্বাভাসকে আরও উন্নত করতে পারে এবং উপকূলীয় জনগণকে দ্রুত সতর্কবার্তা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে।

এই গবেষণা থেকে দেখা যায়, প্রতিটি ধীর ভূ-কম্পনের ফলে পৃথিবীর অভ্যন্তরে কীভাবে শক্তির সঞ্চয় ও মুক্তি ঘটে। যদি আমরা ধীরে ধীরে সরে যাওয়া কোনো ভূমিকম্পের ফাটলকে মাঝপথে ধরতে পারি তাহলে একটি সহজ সত্য সামনে আসে যে, সব ভূমিকম্প গর্জন করে না। কিছু ভূমিকম্প শুধু ফিসফিস করে, নীরবে পাথরের গভীরে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ঢেউ ছড়িয়ে দেয়।
সমুদ্রতলকে শব্দের জালে ঘিরে, গর্জনের আগে ভূমিকম্পের শব্দ শোনাকে প্রাধান্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন সেই ফিসফিসানি শুনতে শুরু করেছেন, আর তার সঙ্গে শুনতে পাচ্ছেন সেই গোপন আলাপচারিতা, যা নির্ধারণ করে কখন পৃথিবী গর্জে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − two =