মঙ্গলগর্ভে অতীত মন্থনের ক্ষতচিহ্ন

মঙ্গলগর্ভে অতীত মন্থনের ক্ষতচিহ্ন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সম্প্রতি মঙ্গলগ্রহের রহস্যময় অতল গহ্বর থেকে উন্মোচিত হল তার প্রাচীন ইতিহাস। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহের ভূপৃষ্ঠে নজর দিলেও ভেতরের অজানা স্তর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কিন্তু নাসার ইনসাইট ল্যান্ডারের পাঠানো তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে লাল গ্রহের ম্যান্টল বা গুরুমন্ডলের গভীরে লুকিয়ে আছে প্রাচীন মহাজাগতিক সংঘর্ষের চিহ্ন।
আজ থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে, সৌরজগৎ তখন ছিল এক অস্থির ক্ষেত্র। বিশাল কোনো গ্রহাণু বা ছোট আদি গ্রহ এসে প্রচণ্ড শক্তিতে মঙ্গলে আছড়ে পড়ে। এই সংঘর্ষ এত তীব্র ছিল যে মঙ্গলের ভূত্বক ও গুরুমন্ডল গলে যায় এবং গলিত শিলার সমুদ্র তৈরি হয়। সেই তীব্র আঘাতে ভাঙা শিলার টুকরোগুলো চাপা পড়ে যায় মঙ্গলের গভীরে।
পৃথিবীতে পাত সংস্থান সবসময় ভূত্বককে নাড়িয়ে ক্ষত নিরাময় করে দেয়। কিন্তু মঙ্গল স্থির, একটিমাত্র প্লেটে গঠিত। তাই তার ভেতরের এই আঘাতগুলো আজও অক্ষত রয়ে গেছে।
২০১৮ সালে মঙ্গলে নাসা ইনসাইট ল্যান্ডার প্রথমবারের মতো সেখানে বসায় সিসমোমিটার (ভূকম্পমাপক যন্ত্র)। এটি চার বছরে ১,৩১৯টি মঙ্গলকম্পকে রেকর্ড করে। কম্পনের তরঙ্গ ভেতরে যেভাবে গেছে , তার বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় গুরুমন্ডলের গভীরে আছে বিশাল পাথরের কিছু টুকরো, যেগুলো ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া।
কম্পিউটার সিমুলেশন দেখায়, কম্পনের উচ্চ-কম্পাঙ্কের তরঙ্গ এগুলোর ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে ধীর হয়ে যায় ও সংকেত বিকৃত হয়। এটিই প্রমাণ করে, এগুলো হল প্রাচীন মহাজাগতিক সংঘর্ষের অবশিষ্টাংশ।

মঙ্গলে কম্পন হয় মূলত দুই কারণে—
১.ভেতরের শিলা অতিরিক্ত চাপ ও তাপে ফেটে যায়।
২.অথবা যদি নতুন মহাজাগতিক বস্তু এসে আঘাত করে।
এই তরঙ্গগুলিই বিজ্ঞানীদের চোখে মঙ্গলের অভ্যন্তরের আসল ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। গবেষকদের মতে, মঙ্গলের গুরুমন্ডল যেন ভাঙা কাঁচের মতো যেখানে বড় টুকরোকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট খণ্ড।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর মতো ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ ভূ-আলোড়ন যদি মঙ্গলে হতো, তবে এই ক্ষত অনেক আগেই মুছে যেত। কিন্তু তা হয়নি। তাই মঙ্গল আজও ধরে রেখেছে প্রাচীন সৌরজগতের অতীতের তীব্র মন্থনের প্রমাণ। এই আবিষ্কার শুধু মঙ্গল নয়, শুক্র আর বুধের মতো গ্রহগুলোর সম্পর্কেও ইঙ্গিত দেয়। সেখানেও পাত সংস্থানগত পরিবর্তন নেই, তাই তারাও হয়তো তাদের অন্তরে জমিয়ে রেখেছে একই রকম মহাজাগতিক আঘাতের চিহ্ন।
মঙ্গলগ্রহ নিস্তব্ধ হলেও তার গভীরে এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কোটি বছরের পুরোনো মহাজাগতিক বিস্ফোরণের কাহিনী। ইনসাইট মিশনের হাত ধরে আমরা সেই অজানা ইতিহাসের সাক্ষী হলাম।

সূত্র: Seismic evidence for a highly heterogeneous martian mantle by Constantinos Charalambous, et.al ; Science (28 Aug 2025 Vol 389, Issue 6763pp. 899-903)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + ten =