মধুপায়ী পরগাছা কি শুধুই গাছের শত্রু ?  

মধুপায়ী পরগাছা কি শুধুই গাছের শত্রু ?  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

শীতের সকালে শহরের কোনো পুরনো ওক গাছের দিকে তাকালে চোখে পড়ে এক প্রকার সবুজ গুচ্ছ, পাতাহীন ডালের বুক চিরে জন্মানো মধুপায়ী পরগাছা বা মিসেল্টো। এই মিসেল্টো হল এক ধরনের আঠালো বীজযুক্ত পরজীবী/আধা-পরজীবী উদ্ভিদ । এরা সাধারণত ওক, মেপল, পাইন গাছের ডালে ঝুলে থাকে। এটি গাছের ভেতরে বিশেষ শোষক অঙ্গ/ হাউস্টোরিয়া প্রবেশ করিয়ে জল ও খনিজ লবণ গ্রহণ করে। তবে এরা নিজের পাতার মাধ্যমেও সামান্য খাদ্য প্রস্তুত করে।

লোককথা ও লোকবিশ্বাসে এর সুনাম–দুর্নাম দুই-ই আছে। বহুদিন ধরেই একে ভাবা হয়েছে গাছের ওপর ঝুলে থাকা এক নিঃশব্দ ঘাতক। কিন্তু ওরেগনের সাতটি শহরে করা সাম্প্রতিক এক বৈজ্ঞানিক জরিপ জানাচ্ছে—এই প্রচলিত ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়।

গবেষকেরা জরিপের সময়কাল হিসেবে শীতকালকে বেছে নিয়েছিলেন সচেতনভাবেই। কারণ এই সময় ওক গাছের শীর্ষভাগে কোনো পাতা থাকে না, ফলে মধুপায়ী পরগাছা অন্ধকার মঞ্চে একমাত্র আলোয় উদ্ভাসিত চরিত্র। রাস্তা, পার্ক, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে শুরু করে সবুজ চলনপথ—পায়ে হেঁটে, সাইকেলে ও গাড়িতে ঘুরে ঘুরে প্রতিটি গাছের অগ্রভাগ খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে।

গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ সত্য। মধুপায়ী পরগাছা বাতাসে ভেসে আসে না, মূলত পাখির গতিবিধির মাধ্যমে ছড়ায়। ফল খাওয়ার পর আঠালো বীজ পাখির ঠোঁট বা মলের সঙ্গে ডালে আটকে যায়। একারনেই বড় ও উঁচু গাছ, যেখানে পাখির আনাগোনা বেশি, সেখানেই মধুপায়ী পরগাছার বাসা বাঁধা স্বাভাবিক। বিশেষ করে পাইন, ওক, নর্দার্ন রেড ওক ও স্কারলেট ওক—এই প্রজাতিগুলো মধুপায়ী পরগাছাদের প্রিয় ঠিকানা।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই গাছগুলোর অধিকাংশই ছিল সুস্থ, দৃঢ় ও প্রাণবন্ত। মধুপায়ী পরগাছা থাকা মানেই গাছ মৃত্যুপথযাত্রী—এই ধারণার কোনো শক্ত-পোক্ত প্রমাণ মেলেনি। ১০ মিটারের নীচু গাছে মধুপায়ী পরগাছা খুবই বিরল, আর যেখানে গুচ্ছ ছিল, সেখানেও গাছের স্বাস্থ্যে তেমন নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। পুরো গবেষণায় মাত্র একটি গাছকে প্রকৃত অবক্ষয়ের লক্ষণসহ শনাক্ত করা হয়েছে।

বরং মধুপায়ী পরগাছা নগর বাস্তুতন্ত্রে এক নীরব সহায়কের ভূমিকা পালন করে। শীতের খাদ্যসংকটে এর ফল পশ্চিমা ব্লুবার্ডসহ বহু পাখির অপরিহার্য খাদ্য। মধুপায়ী পরগাছা বাড়লে পাখির উপস্থিতিও বাড়ে। আর তার সঙ্গে নগর অরণ্যে ফিরে আসে প্রাণের কোলাহল।

অবশ্য সীমা ছাড়ালে সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত মধুপায়ী পরগাছার উপস্থিতি দীর্ঘ খরার সময় গাছের ওপর চাপ বাড়ায়। তাই নগর বন ব্যবস্থাপনায় দরকার সূক্ষ্ম ভারসাম্য—কোথাও ছাঁটাই, কোথাও সহাবস্থানের সুযোগ।

প্রকৃতিতে পরজীবী মানেই শত্রু নয়। কখনো কখনো, সঠিক ভারসাম্যে থাকলে মধুপায়ী পরগাছা নগরের বনাঞ্চলকে আরও প্রাণবন্ত, বৈচিত্র্যময় ও পরিবেশগতভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।

 

সূত্র : Mistletoe is known for killing trees – but is it really harmful? By Sanjana Gajbhiye, published in the journal Northwest Science.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 3 =