মহাকাশে সজীব শৈবাল বীজকোষ 

মহাকাশে সজীব শৈবাল বীজকোষ 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২ ডিসেম্বর, ২০২৫

চরম পরিবেশে টিকে থাকার জন্য শৈবাল বা মস বিশেষভাবে পরিচিত। হিমালয়ের হিমশিখর হোক বা ডেথ ভ্যালির তপ্ত মরুভূমি, কিংবা অ্যান্টার্কটিকার তুন্দ্রা অথবা সক্রিয় আগ্নেয়গিরির লাভা, সব জায়গাতেই তাদের বেঁচে থাকার নজির পাওয়া গেছে। এবার সেই বিস্ময়কর ক্ষমতাকে আরও কঠিন পরিবেশে অর্থাৎ মহাকাশে পরীক্ষা করলেন গবেষকেরা। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের বাইরের খোলা মহাশূন্যে ৯ মাস থাকার পরও মসের স্পোরোফাইটে থাকা ৮০ শতাংশের বেশি স্পোর বা বীজ কোশ জীবিত অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। এমনকি এদের বেশিরভাগই পুনরুৎপাদনেও সক্ষম হয়েছে। এই প্রথম প্রমাণ হল যে পৃথিবীর প্রাচীন ভূমিবাসী শৈবাল কাঠামো দীর্ঘসময় মহাকাশের প্রতিকূলতায় টিকে থাকতে পারে। হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের টোমোমিচি ফুজিতা বলেন, “মানুষসহ অধিকাংশ জীবই মহাকাশের শূন্যতায় এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু শৈবালের স্পোর ৯ মাস সরাসরি সংস্পর্শে থাকার পরও কার্যকর রইল। এটা সত্যিই অভাবনীয়!”

ফুজিতা দীর্ঘদিন ধরে উদ্ভিদের বিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর পরিবেশেও কীভাবে মস সহজে তাদের বসতি গড়ে তোলে, তা তাঁকে সবসময় আকৃষ্ট করেছে। সেখান থেকেই তিনি জানতে চান, পৃথিবীতে এতটাই সহনশীল এই উদ্ভিদ কাঠামো কি মহাকাশেও বাঁচতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষক দল প্রথমে গবেশনাগারে তৈরি এক সিমুলেটেড ‘স্পেস এনভায়রনমেন্ট’- এ ‘স্প্রেডিং আর্থমস’ নামের প্রজাতির তিন ধরনের কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা করেন –

ক। প্রোটোনেমাটা (অল্পবয়সি মস),

খ। ব্রুড সেল (চাপ-প্রসূত বিশেষ স্টেম সেল),

গ। স্পোরোফাইট (যেখানে থাকে আবদ্ধ স্পোর)। গবেষকদের ধারণা ছিল, মহাকাশের অতিরিক্ত অতি বেগুনি রশ্মি, শূন্যতা, তাপমাত্রার চরম ওঠানামা, এবং মাইক্রোগ্র্যাভিটি এই সবের সম্মিলিত চাপ যে কোনো একক চাপের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষতিকর হবে। পরীক্ষার ফল, সেই ধারণাকে স্পষ্টতা দেয়। এক্ষেত্রে অতি বেগুনি রশ্মি ছিল প্রধান হুমকি।

 

প্রোটোনেমাটা তীব্র অতি বেগুনি আলো এবং অতি তাপমাত্রায় টিকতেই পারেনি। ব্রুড সেল তুলনামূলকভাবে ভালো করলেও ব্যর্থ হয়েছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আবদ্ধ স্পোর প্রায় হাজার গুণ বেশি অতি বেগুনি সহনশীলতা দেখায়। -১৯৬°C তাপমাত্রায় এক সপ্তাহের বেশি কিংবা ৫৫°C তাপমাত্রায় টানা এক মাস থেকেও জীবিত থাকে। গবেষক দল মনে করে, স্পোরের চারপাশের প্রাকৃতিক আবরণটি ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করে। এটিই তাদের শারীরবৃত্তীয় ও রাসায়নিক সুরক্ষা দেয়। সম্ভবত এই বৈশিষ্ট্যই প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে জলে থাকা প্রথম দিকের ব্রায়োফাইটদের স্থলে উঠে আসতে সাহায্য করেছিল। এমনকি বিভিন্ন গণবিলুপ্তির ঘটনাও পার হতে সহযোগিতা করেছে। এরপর গবেষকেরা সিদ্ধান্ত নেন আসল পরীক্ষার: মসের স্পোরোফাইট কি বাস্তবে মহাকাশেও টিকে থাকতে পারে? ২০২২ সালের মার্চে শত শত স্পোরোফাইট Cygnus NG-17 মহাকাশযানে করে ISS-এ পৌঁছায়। নভোচারীরা সেগুলোকে স্টেশনের বাইরের অংশে স্থাপন করেন। টানা ২৮৩ দিন ধরে এদের সরাসরি মহাশূন্যের মুখে রেখে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, SpaceX CRS-16 মিশনে, নমুনাগুলিকে পৃথিবীতে ফেরত আনা হয়। ফুজিতার কথায়, “আমরা ভেবেছিলাম হয়তো প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু ফল ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। অধিকাংশ স্পোরই বেঁচে যায়।” ফিরিয়ে আনা নমুনার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশেরও বেশি স্পোর টিকে আছে। বেঁচে থাকা স্পোরের মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ অঙ্কুরোদ্গমে ব্যর্থ হয়েছে। বাকি প্রায় সবই নতুন মস গঠন করে। ক্লোরোফিল পরীক্ষা থেকে দেখা যায়, বেশিরভাগ রঞ্জক স্বাভাবিক স্তরে আছে। শুধু ক্লোরোফিল-এ প্রায় ২০% রঞ্জক কমে গেছে। আলো-সংবেদনশীলতাই এর স্বাভাবিক কারণ।

 

তারা গবেষণার তথ্য ব্যবহার করে একটি গাণিতিক মডেলও তৈরি করেন। মডেল অনুযায়ী এমন পরিবেশে এই স্পোরগুলো প্রায় ১৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। গবেষকেরা মনে করেন, এই ফল ভবিষ্যতে চন্দ্র বা মঙ্গলগ্রহে কৃষি ব্যবস্থা বা পৃথিবীর বাইরে ইকোসিস্টেম গঠনের পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মহাকাশে উদ্ভিদ টেকসইভাবে বাঁচানো গেলে মানুষের বহির্জাগতিক বসতি নির্মাণের পথ আরও উন্মুক্ত হবে।

 

সূত্র : Chang-hyun Maeng, Yuji Hiwatashi, Keita Nakamura, Osamu Matsuda, Hajime Mita, Kaori Tomita-Yokotani, Shin-ichi Yokobori, Akihiko Yamagishi, Atsushi Kume, Tomomichi Fujita. Extreme environmental tolerance and space survivability of the moss, Physcomitrium patens. iScience, 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 5 =