মহাজাগতিক কাচ 

মহাজাগতিক কাচ 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৯ অক্টোবর, ২০২৫

সম্প্রতি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় বিজ্ঞানীরা এমন কিছু ক্ষুদ্র প্রাকৃতিক কাচের টুকরো খুঁজে পেয়েছেন, যা পৃথিবীর উপর প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক বিশাল গ্রহাণু পতনের সাক্ষ্য বহন করছে। এই কাচগুলোকে বলা হয় টেকটাইট। গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর পৃষ্ঠতল গলে গিয়ে বাতাসে ছিটকে উঠে , দ্রুত ঠান্ডা হয়ে কাচে রূপান্তরিত হয় যা দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এদের রাসায়নিক গঠন অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এর ভেতরে রয়েছে খাঁটি সিলিকার দানা, জল নেই বললেই চলে, আর বুনোট এতটাই মসৃণ যে বোঝা যায় এগুলো গলিত শিলা থেকে খুব দ্রুত তৈরি হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন এদের বয়স প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার বছর, অর্থাৎ পরবর্তী মায়োসিন যুগে তৈরি। এ কারণে এগুলোকে পরিচিত অস্ট্রেলেশিয়ান টেকটাইট ফিল্ডের সঙ্গে মেলানো যায় না, যেটি অনেক নবীন – প্রায় ৭.৮ লাখ বছরের পুরনো।

যখন গ্রহাণুর আঘাতে ভূমির শিলা ও অবক্ষেপ গলে যায়, তখন তা দ্রুত ছিটকে আসে বায়ুমণ্ডলে। সেই গলিত কণাগুলো উড়তে উড়তে ঠান্ডা হয়ে কাচে রূপান্তরিত হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে বিশাল এলাকা জুড়ে। এই প্রক্রিয়াতেই জন্ম নেয় টেকটাইট। এগুলো সাধারণত বুদবুদবিহীন, স্বচ্ছ এবং কখনো কখনো এতে থাকে লেচাটেলিয়েরাইট, এক বিশেষ ধরণের খাঁটি সিলিকা।

অস্ট্রেলিয়ার নতুন টেকটাইটগুলোর এ ধরণের বৈশিষ্ট্য থাকলেও তাদের রাসায়নিকগঠন একদম আলাদা। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এদের গঠন অ্যান্ডেসাইটিক থেকে ড্যাসিটিক ধরনের শিলার সঙ্গে মেলে যা সাধারণ মহাদেশীয় ভূত্বক গঠনকারী শিলার সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ন নয়।

বিজ্ঞানীরা এক বিশেষ জিওক্রোনোলজি পদ্ধতিতে এদের বয়স নির্ধারণ করেছেন। এই পদ্ধতিতে নমুনাকে ধাপে ধাপে উত্তপ্ত করে তার আর্গন আইসোটোপ মাপা হয়। ফলাফলে বয়স পাওয়া গেছে প্রায় ১০.৭৬ মিলিয়ন বছর। এ ছাড়া রাসায়নিক বিশ্লেষণে নিকেল, কোবাল্ট ও ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি ধরা পড়েছে যা সাধারণত পাথুরে গ্রহাণুর সংস্পর্শে ঘটেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ, এগুলো নিছক আগ্নেয় কার্যকলাপ নয়, বরং সত্যিই এক মহাজাগতিক আঘাতের ফল।

সবচেয়ে বড় ধাঁধা হলো, এত বিশাল আঘাতের পরও কোথাও কোনো সুনির্দিষ্ট গহ্বর বা ক্রেটার এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। গবেষকদের ধারণা, আঘাতটি সম্ভবত উত্তর অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি কোনো আগ্নেয় আর্ক অঞ্চলে ঘটেছিল। সম্ভাব্য উৎস হিসেবে তারা লুজন, সুলাওসি ও বিসমার্ক অঞ্চলের কথা বলছেন।

 

এক কথায় টেকটাইট আসলে ক্ষুদ্র তথ্যভাণ্ডার । এর প্রতিটি কাচের দানায় লুকিয়ে আছে তৎকালীন তাপমাত্রা, রাসায়নিক গঠন, এমনকি গ্রহাণু আর ভূমির মিশ্রণের তথ্য। এই গবেষণা থেকে বোঝা গেল পৃথিবীতে অতীতে একাধিকবার বিশাল গ্রহাণুর আঘাত ঘটেছে, যেগুলোর সব চিহ্ন আজ আর দৃশ্যমান নেই। আর দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এই ক্ষুদ্র কাচের টুকরোগুলো শুধু এক টুকরো প্রাকৃতিক অদ্ভুত বস্তু নয় এগুলো মহাজাগতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।

 

সূত্র : A new tektite strewn field in Australia ejected from a volcanic arc impact crater 11 Myr ago by Anna Musolino, et.al ; Earth and Planetary Science Letters (Volume 670)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + 15 =