মহাদেশগুলি টিকে আছে কিভাবে? 

মহাদেশগুলি টিকে আছে কিভাবে? 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

পৃথিবীর মহাদেশগুলি আজও টিকে আছে অসংখ্য ভূমিকম্প, অগ্নি-উৎপাত আর টেকটোনিক বিপর্যয়ের পরও।এই স্থায়িত্বের রহস্য কী?কেন কোটি কোটি বছর ধরে মহাদেশগুলো ভেঙে পড়েনি? পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির এক নতুন গবেষণা জানাচ্ছে, এর পেছনে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর অভ্যন্তরের এক প্রাচীন, প্রখর তাপের কাহিনী।

গবেষক অ্যান্ড্রু স্মাই ও তার সহকর্মীরা বলছেন, কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীর গভীরে এমন এক ‘চরম তাপের দহন’ ঘটেছিল, যা ভূ-পৃষ্ঠের নীচের স্তরগুলোকে বদলে দিয়েছিল চিরতরে। সেই অতিরিক্ত তাপই হয়তো মহাদেশকে শক্ত, ঘন ও স্থায়ী করে তুলেছিল।গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিল ভূ-পৃষ্ঠের নীচের শিলা স্তর। এই অবস্থায় নীচের শিলাগুলি আংশিকভাবে গলে যায়। সেই গলিত পদার্থের সঙ্গে উপরে উঠে আসে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম প্রভৃতি তাপ উৎপাদনকারী মৌল। উপাদানগুলি যখন বেরিয়ে যায়, তখন নীচের স্তরে তাপ উৎপাদন কমে আসে। ধীরে ধীরে সেই অংশ ঠান্ডা হয়ে ঘন ও শক্ত হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, পৃথিবীর মহাদেশীয় অংশ তৈরি হয় এক অভেদ্য পাথরের স্তরে।এই স্তরই আজকের মহাদেশগুলির স্থায়িত্বের ভিত্তি। স্মাইয়ের ভাষায়, “অতীতের সেই চরম তাপ একপ্রকার পরিশোধনের কাজ করেছিল, যেন পৃথিবী নিজেই নিজের গভীরতাকে শুদ্ধ করেছে।”

আজ পৃথিবীর প্রাচীনতম ও সবচেয়ে স্থিতিশীল ভূখণ্ডগুলিকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ক্র্যাটন’। এরা হলো মহাদেশের কেন্দ্রভাগ, যেখানে শিলাস্তরগুলো কয়েকশো কোটি বছর ধরে প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় আছে। এই ক্র্যাটনগুলির নীচের অংশই একসময় গলে গিয়ে আবার ঠান্ডা হয়ে শক্ত হয়েছিল। ফলে সেখানে তৈরি হয় এক অবিচল পাথরের ভিত্তি, যা টেকটোনিক চাপ, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ বা ভূমিকম্প – কোনো কিছুর কাছেই সহজে হার মানে না। এই ধারণাটিই পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী ভূগঠনের ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন এক চাবিকাঠি। গবেষক দলটি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার প্রাচীন শিলা পরীক্ষা করে এই রহস্য উন্মোচন করেছে। শিলার ভেতরে থাকা খনিজ জিরকন ও মোনাজাইট-এর মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন অতীতে ওই অঞ্চলে কী পরিমাণ তাপ লুকিয়ে ছিল।

খনিজগুলি উচ্চ তাপমাত্রায় গলে গিয়ে তাদের মধ্যে থাকা ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম ছেড়ে দেয়। গলিত অংশগুলো উপরে উঠে এসে ভূ-পৃষ্ঠে নতুন খনিজ স্তর তৈরি করে। সেই স্তরগুলিই আজ রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস-এর এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। অর্থাৎ, এই প্রাচীন গলন প্রক্রিয়া কেবল মহাদেশ গঠনে নয়, পরবর্তী কালে প্রযুক্তি-নির্ভর মানবসভ্যতার উপাদান গঠনেও ভূমিকা রেখেছিল। যদিও আজকের পৃথিবী অনেক ঠান্ডা, তবু গবেষকরা বলছেন, চরম তাপের এই প্রক্রিয়া আজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। হিমালয়, আন্দিজ বা আফ্রিকার কিছু অংশে, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের নীচে টেকটোনিক চাপ প্রবল, সেখানে এখনও ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা তৈরি হতে পারে।এই স্থানগুলোতেই হয়তো আজও ঘটে চলেছে ধীরে ধীরে ‘ক্রাস্টাল’ গলনের, নতুন শিলাস্তর গঠনের, এক অদৃশ্য প্রক্রিয়া- যার ছায়া পড়ে কোটি কোটি বছর আগের পৃথিবীর তাপঘূর্ণির ওপর।

গবেষণাটি পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিয়ে প্রচলিত ধারণায় নতুন আলো ফেলেছে। গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর মতো অন্য কোনো গ্রহেও যদি একসময় এমন চরম তাপ ও গলন প্রক্রিয়া ঘটে থাকে, তবে সেখানেও মহাদেশ বা স্থিতিশীল ভূখণ্ড গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ, এই গবেষণা শুধু পৃথিবীর অতীত বোঝার চাবিকাঠিই নয়—এটি ভবিষ্যতের গ্রহ অনুসন্ধান, এমনকি দূর গ্রহের ভূতত্ত্ব অনুধাবনেরও এক নতুন জানালা খুলে দিচ্ছে।

 

সূত্র : Ultra-hot origins of stable continents by Andrew J. Smye; Published: 13 October 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × four =