মহাদেশীয় ভূত্বকের ক্ষয়

মহাদেশীয় ভূত্বকের ক্ষয়

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ জুলাই, ২০২৫

একটি নতুন গবেষণা মারফত বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো মহাদেশীয় ভূত্বক ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এই প্রাচীন ভূত্বকের গভীর শিকড় বা ‘ক্র্যাটন’ এতটাই শক্ত ও ঠান্ডা যে, তাকে সহজে ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু চীনের ‘চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সেস’-এর অধ্যাপক শাওফেং লিউ-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এক মডেলিং গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, নির্বিচারে চলতে থাকা ভূ-ত্বকের সংস্থাপিত পাতের গতি ও গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এই পুরনো ভূ-ত্বক ক্ষয়ে যেতে পারে।

মহাদেশীয় ভূ-ত্বক হলো পৃথিবীর শক্ত ও কঠিন বাহ্যিক স্তর, যা মূলত গ্রানাইটের মতো আগ্নেয় শিলা দ্বারা গঠিত। এগুলোর ঘনত্ব মহাসাগরীয় ভূ-ত্বকের তুলনায় কম, ফলে এরা তুলনামূলকভাবে বেশি উচ্চতায় ভেসে থাকে আর তার ফলেই তৈরি হয় পাহাড়, মালভূমি এবং উপত্যকা। মহাসাগরীয় ভূ-ত্বক বারবার সাবডাকশন বা অধোগমনের মাধ্যমে পুনঃচক্রিত হলেও মহাদেশীয় ভূ-ত্বক কয়েক বিলিয়ন বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারে।

২৫০ কোটি বছরেরও পুরনো ‘নর্থ চায়না ক্র্যাটন’ একসময় প্রায় ৫ লাখ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। কিন্তু জুরাসিক যুগে যখন এটি ‘ইজানাগি’ মহাসাগরীয় প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন এই সংঘর্ষের কারণে ভূ-ত্বকের নীচে একটি সমতল অধোগমন স্তর তৈরি হয়। গবেষণায় দেখা যায়, এর ফলে ভূ-ত্বক সংকুচিত হয়ে পুরু হয় এবং অধোগমন অঞ্চল থেকে ম্যাগমা বেরিয়ে এসে পাহাড়ের উচ্চতা বৃদ্ধ্বি পায় আর বাকি লাভা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জমে যায়।প্রায় ১৩৬ মিলিয়ন বছর আগে পাতের আপেক্ষিক গতিপথ বদলে যায়, পাতের এক প্রান্ত সমুদ্রের দিকে সরে যেতে শুরু করলে নীচের স্তরে চাপ তৈরি হয়, যাকে ‘লার্জ ম্যান্টল ওয়েজ’ বলা হয়। এর ফলে ভূত্বকের নিচের স্তর দুর্বল হয়ে পড়ে, ঘনত্ব কমে যায় এবং শিলা সহজে গলে যেতে থাকে। এতে ‘ক্র্যাটনের’ শক্ত ভিত্তি ভেঙে যায় এবং ভূ-ত্বক পাতলা হয়ে যায়। বর্তমানে পূর্ব চীনের ভূ-ত্বক পূর্বের তুলনায় অর্ধেকেরও কম পুরু।

এমন ঘটনা কেবল চীনে নয়, উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালায়ও ঘটেছে। গবেষকরা বলছেন, ক্র্যাটনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে এর ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর। অভ্যন্তরীণ ক্র্যাটনগুলো তুলনামূলক নিরাপদ হলেও, উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো পাতের অধোগমন এবং ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বেশি থাকে।
ভূ-ত্বকের এই পরিবর্তন শুধু কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান নয়, খনিজ সম্পদ, আগ্নেয়গিরি, নদীর গতিপথ এবং ভবিষ্যতের বন্যা পরিস্থিতিতেও গভীর প্রভাব ফেলে। এই গবেষণা থেকে দেখা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শিলাও সময়ের সঙ্গে কিভাবে ক্ষয়ে যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen + 12 =