দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরু- ভারতের এই পাঁচ মহানগর আজ এক অদৃশ্য সংকটের মুখে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই শহরগুলোর নীচের মাটি প্রতি বছর কয়েক মিলিমিটার করে নীচে দেবে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভূমির অবনমন ঘটছে। যার প্রধান কারণ অতিরিক্ত ভূগর্ভজল উত্তোলন। এই প্রবণতা শুধু বাসভবনগুলোর স্থিতি নয়, বরং বন্যা ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিকেও বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে।
এই গবেষণাটি ২০২৫ সালের ২৮ অক্টোবর নেচার সাস্টেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত উপগ্রহ রেডার উপাত্ত ব্যবহার করে পাঁচটি শহরের ১ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি উঁচু অট্টালিকা এবং প্রায় ৮ কোটি মানুষের ওপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা গেছে, মোট ৮৭৮ বর্গ কিলোমিটার শহুরে এলাকা ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে, এবং প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর ৪ মিলিমিটারেরও বেশি হারে ভূমিধসের ঝুঁকিতে আছে।
সবচেয়ে দ্রুত ভূমি ধসের হার রেকর্ড হয়েছে—দিল্লিতে বছরে ৫১ মিমি, চেন্নাইয়ে ৩১.৭ মিমি, মুম্বাইয়ে ২৬.১ মিমি, কলকাতায় ১৬.৪ মিমি এবং বেঙ্গালুরুতে ৬.৭ মিমি। দিল্লি-এনসিআরের বিজওয়াসন, ফরিদাবাদ ও গাজিয়াবাদ এলাকায় ধসের হার সবচেয়ে বেশি। চেন্নাইয়ে আদিয়ার নদীর বন্যাপ্রবণ তীর ও শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত- যেমন, কোডামবাক্কম, আলান্দুর, টোন্ডিয়ারপেট।
দিল্লিতে নদীবাহিত পলিমাটির অবক্ষেপের অতিরিক্ত সংকোচনই ভূমি ধসের প্রধান কারণ। চেন্নাইতেও সেই একই চিত্র। আদিয়ার নদীর তীরবর্তী বালুমিশ্রিত জমিতে অতিরিক্ত পাম্পিংয়ের কারণে মাটি ধসে পড়ছে। কলকাতায়ও প্লাইস্টোসিন ও হোলোসিন যুগের নরম মাটির সংকোচনের ফলে একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
বেঙ্গালুরুতে গ্রানাইট ও নিস শিলা অর্থাৎ শিলাময় মাটি থাকার কারণে ভূমিধস কিছুটা কম হলেও, ২০২২ সালের শেষ দিকে শহরে ভূগর্ভস্থ জলের উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যদিকে মুম্বাইয়ে, বিশেষ করে ধারাভি বস্তির মতো ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র অঞ্চলে ধসের হার বেশি।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই অব্যাহত ভূমিধসের কারণে ভবিষ্যতে লক্ষাধিক বহুতল অট্টালিকা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ইতিমধ্যেই দিল্লিতে ২,২৬৪টি অট্টালিকা, মুম্বাইয়ে ১১০টি, এবং চেন্নাইয়ে ৩২টি অট্টালিকা মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে। আগামী ৫০ বছরে এই সংখ্যা বেড়ে ২৩,৫০০টিরও বেশি হতে পারে। চেন্নাই ভবিষ্যতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এতো ভাঙা গড়ার মাঝেও আশার বিষয় এই যে, দিল্লির দ্বারকা অঞ্চলে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে জল পুনর্ভরাট করার নীতির কারণে ভূমি প্রতি বছর ১৫.১ মিমি হারে উঁচু হচ্ছে। এককথায় এর পেছনে রয়েছে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনে নিয়ন্ত্রণ, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, এবং পুরনো জলাশয় পুনরুদ্ধার ইত্যাদি নীতি।
গবেষকরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, যদি এখনই ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, বেশি করে গাছ লাগানো অথবা মাটি সংরক্ষণ প্রভৃতি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ভারতের শহরগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের ভিত্তি হারাবে।
এখনই সময় মাটির নীচের এই নীরব বিপর্যয়কে গুরুত্ব দিয়ে টেকসই নগরজীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার।
সূত্র : Land beneath India’s five largest cities is sinking due to over-extraction of groundwater: Study by
Susan Chacko, published in the journal Nature Sustainability ,30th october,2025.
