মাদাগাস্কারের জীববৈচিত্র্যর ভূতাত্ত্বিক কারণ

মাদাগাস্কারের জীববৈচিত্র্যর ভূতাত্ত্বিক কারণ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ নভেম্বর, ২০২৫

ভারত মহাসাগরের এক অনন্য দ্বীপ মাদাগাস্কার। এখানে পৃথিবীর অসংখ্য বিরল প্রাণ ও উদ্ভিদের বাস। কিন্তু এই জীববৈচিত্র্যের সূচনা কোথা থেকে? সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দ্বীপের জীবজগৎ কোনো “জীববৈজ্ঞানিক কাকতালীয় ঘটনা ” নয়। এর পিছনে আছে এক বিশাল ভূতাত্ত্বিক বাঁক। প্রায় ১৭০ কোটি বছর আগে, মাদাগাস্কার আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আলাদা হতে শুরু করে। সেই প্রাচীন ভাঙন বা রিফটিং-এর ফলে দ্বীপটির পশ্চিম প্রান্তে তৈরি হয় এক বিশাল খাড়া ঢাল আর পূর্বদিকে এক উঁচু মালভূমি। সেই সময় দ্বীপের নদীগুলো প্রবাহিত হতো পূর্ব দিকে, সোজা ভারত মহাসাগরের দিকে। কিন্তু প্রায় ৯০ কোটি বছর আগে ঘটে দ্বিতীয় বড় ভাঙন। এইবার মাদাগাস্কার ভারত ও সিশেলস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ভূকম্পজাত পরিবর্তনের ফলে সম্পূর্ণ ভূখণ্ডটা একেবারে কাত হয়ে পড়ে পশ্চিমদিকে। নদীগুলির গতিপথ যায় ঘুরে। জলবণ্টনের চরিত্র আমূল বদলে যায়। এই পরিবর্তনই পরবর্তীতে দ্বীপের অভ্যন্তরে জটিল পাহাড়ি, নদীমাতৃক ও সমতল ভূ-প্রকৃতির জন্ম দেয়। ভূমি যখন কাত হয়, নদীর প্রবাহও বদলায়। কিছু জায়গায় নদী নতুন খাতে বইতে শুরু করে, কোথাও পাহাড়ের পেট কেটে নতুন গিরিখাত সৃষ্টি হয়। একে বিজ্ঞানীরা বলেন “নিক পয়েন্ট”বা খাঁজ এলাকা। সেখানে ক্ষয়প্রবণ নদী হঠাৎই নতুন গতি পায়। এই ক্ষয় ও উত্তোলনের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদাগাস্কারের কিছু অংশে প্রতি কোটি বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৩০০০ মিটার পর্যন্ত ভূমি উচ্চতা বদলেছে। ফলাফল? একই দ্বীপে গড়ে উঠেছে নানা রকম ক্ষুদ্র জলবায়ু এলাকা ও ভূ-প্রকৃতি। কেউ শুষ্ক, কেউ বৃষ্টিবহুল, কেউ আবার ঠান্ডা ও পাহাড়ি। এই বহুবিভক্ত ভূ-দৃশ্যই জীববৈচিত্র্যের এক নিখুঁত পরীক্ষাগার হয়ে ওঠে। আজ মাদাগাস্কারের প্রায় ৯০ শতাংশ স্তন্যপায়ী, ৮০ শতাংশ গাছপালা ও অসংখ্য সরীসৃপ এমন প্রজাতির, যাদের পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। অনেকে ভাবতেন, এর কারণ শুধুই দ্বীপটির দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, আসল রহস্য লুকিয়ে আছে ভূ-প্রকৃতির ক্রমাগত রূপান্তরেই। যখন ভূমির ঢাল পাল্টায়, নদীর গতিও পাল্টে যায়। ফলে কোনো অঞ্চলে জল সহজে পৌঁছায় না, আবার কোথাও তৈরি হয় স্থায়ী নদী বা হ্রদ। এই বিভাজনেই এক অঞ্চলের প্রাণীরা অন্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে আলাদা পথে বিবর্তিত হতে থাকে। গবেষক রোমানো ক্লেমেন্তুচি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে জলবিভাজন। যখন প্লেট ঢলে যায়, নদী পূর্ব থেকে পশ্চিম বা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরে যায়। এতে পুরো জলবণ্টন ব্যবস্থা বদলে যায়, আর তার সঙ্গেই বদলে যায় জীবনের ছকও।“ মাদাগাস্কারের উত্তর ও মধ্যভাগ এখনো ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয়। ভূমি ক্রমাগত উঁচু হচ্ছে, ক্ষয়িত হচ্ছে। আর আশ্চর্যের বিষয়, এই অঞ্চলেই উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, ভূ-প্রকৃতি যত দ্রুত বদলায়, তত দ্রুতই জীববৈচিত্র্যও অভিযোজিত হয়। দ্বীপটি বাইরে থেকে শান্ত মনে হলেও, এর গভীরে চলেছে এক নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের ধারা। প্লেটের নড়াচড়া, নদীর পথবদল, পাহাড়ের ক্ষয় – এইসব প্রক্রিয়া যেন জীবনের নতুন তাল রচনা করছে। ভূমি যেন নিজেই এক শিল্পী, যে নিজের ক্যানভাসে ক্রমাগত নতুন নকশা আঁকছে। আর সেই নকশার ওপর দাঁড়িয়েই জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রাণ, নতুন পরিবেশ। আজ মাদাগাস্কার শুধু এক দ্বীপ নয়, এক জীবন্ত পাঠশালা, যেখানে পাথর, নদী আর জীব একসঙ্গে লিখে চলেছে বিবর্তনের ইতিহাস।

সূত্র: lution: A tale of two rifts Romano Clementucci; et.el; Science Advances; 15 Oct 2025,Vol 11, Issue 42.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 2 =