মানবকোষে রেবিসের দখলদারি

মানবকোষে রেবিসের দখলদারি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩০ নভেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংক্রমণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল জলাতঙ্ক । এটি মূলত রেবিস ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট। এ ভাইরাস সাধারণত সংক্রমিত প্রাণীর কামড়, আঁচড় বা লালার সংস্পর্শে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। একবার লক্ষণ দেখা দিলে এই রোগ প্রায় সব ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হয়। এতদিন অবধি এভাবেই আমরা রেবিস ভাইরাসকে সাধারণত প্রাণঘাতী সংক্রমক হিসেবে জেনে আসছি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন জানাচ্ছেন—এর ভয়ংকর ক্ষমতার আসল রহস্য লুকিয়ে আছে এক বিশেষ প্রোটিনে, যা রেবিসকে মানুষের কোষে ঢুকে কোষের কাজকর্মকে সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে—এই ভাইরাস অত্যন্ত অল্প জিনগত উপাদান ব্যবহার করেই মানবকোষের ভেতরের জটিল প্রক্রিয়াগুলোকে বলপূর্বক নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম । এত অল্প জিনগত উপাদান ব্যবহার করেও রেবিস এমন সব কাজ করতে পারে, যা আগে সত্যি কল্পনাও করা যায়নি। নেচার কমিউনিকেশন্স-এ প্রকাশিত এই গবেষণা ভাইরাসবিজ্ঞানে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছে এবং এই ফলাফল ভবিষ্যতের ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিভাইরাল উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

মানবকোষে যেখানে প্রায় ২০,০০০ প্রোটিন কাজ করে, সেখানে রেবিস ভাইরাসের অস্ত্রভাণ্ডারে আছে মাত্র পাঁচটি। তবু এই ভাইরাস কোষে ঢোকার পর প্রোটিন তৈরির যন্ত্রপাতি দখল করে, কোষের অভ্যন্তরীণ বার্তা-বিনিময় ব্যাহত করে এবং প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থাকে স্তব্ধ করে দেয়। গবেষকেরা দেখেছেন—এ সবকিছু সম্ভব হয় ‘পি’ নামের একটি প্রোটিনের মাধ্যমে। সে যেন একাই পুরো প্রতিরক্ষা সেনাবাহিনীকে কুপোকাত করে দিতে পারে।

রেবিসের পি প্রোটিনের সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো, এটি আকার বদলাতে পারে। এই “শেপ-শিফটিং” ক্ষমতার জন্য একটি প্রোটিনই অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন কাজ করতে পারে। আরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই প্রোটিন আর এন এ-র সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। আর এন এ আমাদের কোষে বার্তা বহন করে, রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ করে এবং প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে। পি প্রোটিন আর এন এ-কে লক্ষ্য করে কোষের ভেতরের নানা তরল-মতো অংশে ঢুকে সেখানে চলমান প্রক্রিয়াগুলোকে নিজেদের অনুকূলে বদলে ফেলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, রেবিসের পি প্রোটিন কোষের নিউক্লিয়াস ও নিউক্লিওলাসসহ বিভিন্ন তরল-ধর্মী অংশে জড়ো হয়ে সেগুলোকে কার্যত ভাইরাস তৈরির কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে কোষ নিজের স্বাভাবিক কাজ ভুলে বেশি করে রেবিস ভাইরাস বানানোর অকাজে মনোনিবেশ করে। গবেষকদের বিশ্বাস, নিপা ও ইবোলার মতো মারণ ভাইরাসও হয়তো একই কৌশল ব্যবহার করে। বোঝাই যাচ্ছে এই আবিষ্কার ভবিষ্যতের প্রাণঘাতী ভাইরাস-নিয়ন্ত্রণ গবেষণায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

 

বিজ্ঞানীরা এতদিন ভাবতেন, একটি প্রোটিনের প্রতিটি অংশ হয়তো এক- একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু রেবিসের পি প্রোটিনটির ক্ষেত্রে —প্রোটিনের অভ্যন্তরীণ ভাঁজ, অংশগুলোর ক্রিয়া এবং আরএন এ-র সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতাই তাকে নতুন নতুন কার্যক্ষমতা দেয়।

ছোট ছোট সংস্করণ থেকেও নতুন বৈশিষ্ট্যের জন্ম হতে পারে—যা ভাইরাসকে আরও অভিযোজিত ও শক্তিশালী করে তোলে।

এই আবিষ্কার ভাইরাসের অভিযোজনক্ষমতা ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করছে এবং ভবিষ্যতে প্রাণঘাতী সংক্রমণ মোকাবিলায় নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে।

 

সূত্র : “Conformational dynamics, RNA binding, and phase separation regulate the multifunctionality of rabies virus P protein” by Paul R. Gooley , Gregory W. Moseley,et.al; 29th October 2025, published in Nature Communications.

DOI: 10.1038/s41467-025-65223-y

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 5 =