মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধের নতুন পদ্ধতি

মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধের নতুন পদ্ধতি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

সারা বিশ্ব জুড়ে লক্ষলক্ষ মানুষ প্রতিবছর মূত্রনালীর সংক্রমণে ভোগেন। মূত্রত্যাগ করতে গিয়ে জ্বালা করার অন্যতম কারণ হল মূত্রনালীতে জীবাণু সংক্রমণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ই কোলাই নামের এক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। অনেকেরই আবার দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের প্রবণতা রয়েছে, বিশেষ করে মহিলা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের। এই সংক্রমণ সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিত্সা করা হয়। তবে এই ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার জীবাণুকে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে তুলতে পারে, ফলে ওষুধের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে।
মূত্রনালীর দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের সমস্যা সমাধানে গবেষকরা মাইক্রো-বায়োলজি আর ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল কাজে লাগিয়ে এমন এক জীবিত পদার্থ তৈরি করতে পেরেছেন যা ই কোলাই–এর একটি বিশেষ উপকারী প্রজাতিকে আশ্রয় দিতে পারে। দেখা গেছে এই জৈব পদার্থ থেকে নির্গত “ভালো” ব্যাকটেরিয়া “খারাপ” ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে পুষ্টি আহরণের জন্য দ্বন্দ্বে নামে এবং জিতে যায়। ফলত অসুখ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যায়। আরও উন্নতি ঘটালে এই প্রকৌশল অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ না-দেওয়া মূত্রনালীর সংক্রমণ যাতে ফিরে ফিরে না-আসে সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয়।
মানুষের দেহ-নিবাসী জীবাণুদের জন্য পুষ্টির জোগান সীমিত। ব্যাকটেরিয়াদের অন্যান্য জীবাণুর সাথে এবং আশ্রয়দাতার সাথেও প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। শরীরে পুষ্টিকর উপাদান যা আছে উপকারী ব্যাকটেরিয়া সেগুলি সংগ্রহ করে খেয়ে ফেলার ফলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি থেমে কিংবা শ্লথ হয়ে যায়। প্রয়োজন মতো পুষ্টি না-পেয়ে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া আর যথেষ্ট বাড়তে পারে না, ফলে অসুখও সৃষ্টি করতে পারে না।
তবে মূত্রথলিতে এই উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের পৌঁছে দেওয়াটা বেশ কঠিন ব্যাপার। তার একটা কারণ হল, এইসব উপকারী ব্যাকটেরিয়া স্বভাবত একমাত্র সেইসব রোগীর দেহেই বসতি তৈরি করে যারা মূত্রথলি পুরোপুরি খালি করতে অক্ষম। এই অবস্থাকে বলা হয় “মূত্র জমা”। কিন্তু এমনকি এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রেও এইসব ব্যাকটেরিয়া কার মূত্রথলিতে কতক্ষণ বসতি স্থাপন করে থাকতে পারবে তার কোনো ঠিক নেই। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। মূত্রথলির ভিতরে এই ব্যাকটেরিয়া পৌঁছে দেওয়ার বর্তমান পদ্ধতিগুলো জটিল, তার জন্য বারবার ক্যাথিটার ঢোকাতে হয়। এমনকি মূত্রথলির ভিতরে ব্যাকটেরিয়া ঠিকমতো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলেও মূত্র তাদের ঠেলে বার করে দেয়, কারণ এই ব্যাকটেরিয়া মূত্রথলির গা আঁকড়ে ধরতে পারে না।
উপকারী ব্যাকটেরিয়া যেহেতু মূত্রথলি আঁকড়ে ধরতে পারে না এবং বেশিক্ষণ টিকতে পারে না, তাই গবেষকরা এমন এক জৈব পদার্থ তৈরি করেছেন, যা অনেকক্ষণ ঘরে একটু একটু করে মূত্রথলির মধ্যে ব্যাকটেরিয়া ছাড়তে থাকবে। জেলের তৈরি এই জৈব পদার্থটি ই কোলাইয়ের কাঠামোর মধ্যেই গাঁথা থাকে। এটি খুবই ছোটো – এক ফোঁটা জলের পাঁচশ ভাগের একভাগের সমান এক টুকরো জেলির মতন। এটি মূত্রথলির মধ্যে দু সপ্তাহ ধরে ব্যাকটেরিয়া ছাড়তে পারে।
মানুষের মূত্র বিশেষ পাত্রে ধরে তার মধ্যে এই জৈব পদার্থটিকে মূত্রনালীর রোগজনক জীবাণুর সংস্পর্শে রেখে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার ফল থেকে দেখা গেছে, ৫০ : ৫০ অনুপাতে মেশালে এই ই-কোলাইটি মূত্রনালীর রোগজনক ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেয়। মোট ব্যাকটেরিয়া সমষ্টির মধ্যে তারাই হয়ে ওঠে ৮৫%। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য থাকবে শরীরে মূত্রনালী সংক্রামক ব্যাকটেরিয়ার সাপেক্ষে আরও বেশি মাত্রায় ই-কোলাই ছাড়া। এখন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সময় সেই কাজটাই করে দেখা গেছে, মোট ব্যাকটেরিয়া সমষ্টির মধ্যে ই কোলাই-এর অনুপাত হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯%। অর্থাৎ কার্যত মূত্রনালী সংক্রামক ব্যাকটেরিয়াগুলো সাফ হয়ে গেছে। তাছাড়া এই জৈব পদার্থটি মানুষের মূত্রের মধ্যে একটানা দু সপ্তাহ পর্যন্ত ই কোলাই ছাড়তে পারবে। এইসব ফল থেকে মনে হয়, ই কোলাই আরও অনেক বেশি সময় ধরে মূত্রথলির মধ্যে বেঁচেবর্তে থাকতে পারবে এবং নানা ধরণের মূত্রনালী-সংক্রামক ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি কমাতে সক্ষম হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 4 =