একসময় মনে করা হতো দূরবর্তী গ্রহগুলোর ঘন মেঘ জীবনের উপস্থিতি আড়াল করে রাখে । কিন্তু সম্প্রতি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে ঠিক এর উল্টোটাও হতে পারে। মেঘের মধ্যেই যদি রঙিন অতি সূক্ষ্ম জীবাণু/মাইক্রোব ভেসে থাকে, তবে তাদের রঙিন স্বাক্ষরই হতে পারে ভিন গ্রহবাসীদের জীবনের প্রথম ইঙ্গিত। এই প্রথম পৃথিবীর আকাশে থাকা এমন মাইক্রোবদের রিফ্লেকট্যান্স স্পেকট্রা, অর্থাৎ আলো প্রতিফলনের সুনির্দিষ্ট রঙের প্যাটার্ন, তৈরি করেছেন কর্নেলের গবেষকরা। এই বিশদ সংগ্রহ নিশ্চিতরূপে ভবিষ্যতের ভিনগ্রহে জীবন-অনুসন্ধান মিশনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন কর্নেলের কার্ল সেগান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী লিজিয়া কোয়েলো। তাঁর গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল মাইক্রোবের তৈরি জৈবরঞ্জক, যেগুলো আলো শুষে নেয় বা প্রতিফলিত করে, কীভাবে তারা গ্রহের আলোতে শনাক্তযোগ্য স্বাক্ষর রেখে যায়। কোয়েলোর মতে, পৃথিবীর আকাশে রঙিন মাইক্রোবের অস্তিত্বই দেখায় যে অন্য গ্রহের মেঘেও জীবনের রঙিন ইঙ্গিত থাকতে পারে। গবেষণায় যুক্ত লিসা কালটেনেগারের বক্তব্য, এই ধারণা প্রচলিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে। আগে মনে করা হতো, ঘন মেঘ গ্রহপৃষ্ঠের সংকেত ঢেকে দেয়। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, মেঘের মধ্যেই যদি রঙিন জীবাণু ভেসে থাকে, তবে তাদের সম্মিলিত রঙই হতে পারে জীবনের অন্যতম শক্তিশালী সংকেত।
গবেষক দলটি দৃশ্যমান এবং অবলোহিত আলোতে সাত ধরনের বায়ুমণ্ডলীয় মাইক্রোবের রঙ-প্রতিক্রিয়া মেপে যেন রঙের বিস্তারিত এক গ্রন্থাগার তৈরি করেছেন। এসব মাইক্রোব সংগৃহীত হয়েছে পৃথিবীর নিম্ন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার থেকে। তা ঠান্ডা, শুষ্ক এবং জীবনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ হলেও নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়া সেখানে বেঁচে থাকে। বেলুন মিশনের মাধ্যমে ১৩ থেকে ১৮ মাইল উচ্চতা থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলো ল্যাবে বৃদ্ধি করে ভেজা ও শুকনো উভয় অবস্থায় তাদের রঙ বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা গেছে, শুকনো নমুনা বেশি আলো প্রতিফলিত করে, ফলে হলুদ-কমলা পিগমেন্ট আরও স্পষ্ট হয়; আর ভেজা নমুনা ৪০০–৬০০ ন্যানোমিটার পরিসরে তীক্ষ্ণ শোষণ বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রঞ্জকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই উপাত্ত ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মডেল তৈরি করেছেন। সেখানে দেখানো হয়েছে, যদি মেঘের ভেতর রঙিন মাইক্রোব থাকে, তবে তাদের সম্মিলিত রঙ একটি গ্রহের বর্ণালীতে পরিষ্কার পরিবর্তন ঘটায়, বিশেষ করে প্রায় ৫০০ ন্যানোমিটারের আশেপাশে। এই ধরনের সংকেত অনুসন্ধান করবে আসন্ন নাসার বাসযোগ্য গ্রহ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র মিশন। আর ভূমি-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণে বিপ্লব আনবে ই এস ও -এর অতি বৃহৎ দূরবীক্ষণ যন্ত্র।
এই অনুজীবীয় রঞ্জক – যেমন ক্যারোটিনয়েড – তাদের রঙিন করে এবং সূর্যের তীব্র বিকিরণ থেকে রক্ষা করে। একই সঙ্গে এগুলো মেঘের অ্যালবেডো/ আলো প্রতিফলনের ক্ষমতা পরিবর্তন করতে পারে, যা দূরবর্তী পর্যবেক্ষণে জীবনের সম্ভাব্য চিহ্ন হিসেবে ধরা পড়তে পারে।
যদিও পৃথিবীর আকাশে মাইক্রোব খুবই অল্প, অন্য গ্রহে ঘন বায়ুমণ্ডল বা শক্তিশালী উপর নীচ মিশ্রণে এদের ঘনত্ব বাড়তে পারে, যা দূর থেকে শনাক্ত করা সম্ভব। তবে কোনো রঙই তো আর সরাসরি জীবনের প্রমাণ নয়। ধূলিকণা , কুয়াশাচ্ছন্ন ধোঁয়া বা যন্ত্রের ত্রুটিও অনুরূপ বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পারে। তাই প্রকৃত জীবনের সংকেত হিসেবে বিবেচিত হতে গেলে রঙিন মেঘের সংকেতের সঙ্গে জলসমৃদ্ধ পরিবেশ, সহনীয় বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিক গঠন এবং পুনরায় পর্যবেক্ষণের সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
এই গবেষণা জীবনের অস্তিত্ব শনাক্তকারী একদম আলাদা মাত্রার এক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করল। আজ আর আমরা দাবি করতে পারবো না যে জীবনের সন্ধান শুধুমাত্র গ্রহের পৃষ্ঠ বা বায়ুমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ। বরং আকাশের মেঘও হতে পারে ভিনগ্রহবাসীদের জীবনের প্রাথমিক উজ্জ্বল রঙিন ইশারা।
সূত্র : Colors of Life in the Clouds: Biopigments of Atmospheric Microorganisms as a New Signature to Detect Life on Planets like Earth by Lisa Kaltenegger, William Philpot,et.al; published in The Astrophysical Journal Letters , 11th November,2025.
DOI 10.3847/2041-8213/ae129a
