মেটা-র ভবিষ্যত নিয়ে উঠল প্রশ্ন

মেটা-র ভবিষ্যত নিয়ে উঠল প্রশ্ন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ এপ্রিল, ২০২২

মেটাভার্স’ শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচয় হয়েছে। এটি মূলত ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া। এটি এমন ত্রিমাত্রিক ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারেন। প্রত্যেকের ত্রিমাত্রিক আভাটার বা অবতারের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় পারস্পরিক যোগাযোগ হয়ে থাকে। ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ বলেছেন, ফেসবুকসহ তাঁর প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সেবার ভবিষ্যৎ হলো এই মেটাভার্স। তাই তিনি ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে রেখেছেন ‘মেটা’। ধারণা করা হচ্ছিল, নাম পরিবর্তন করে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু মেটা এখন বেশ কিছু বাধার মধ্যে পড়েছে। ইয়াহু নিউজের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সে তথ্য।

মেটার ঝকঝকে ভবিষ্যতের পথে বড় ধাক্কা দেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পণ্য ব্যবস্থাপক ফ্রান্সিস হাউগেন। তিনি অভিযোগ করেন, সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমটি বিদ্বেষ বার্তা (হেইট স্পিচ) ছড়ানোর প্রভাব থেকে মুনাফা করে থাকে। গত বছরের অক্টোবরে ফেসবুকের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি অভিযোগ করেন, ফেসবুক নিঃসন্দেহে ঘৃণাকে আরও তীব্র করে তোলে। সেই সঙ্গে কোম্পানিটির নিরাপত্তা দলে লোকবল রয়েছে অপর্যাপ্ত। নিরাপত্তার খাতিরে সামান্য মুনাফাও ছাড় দিতে রাজি নয় ফেসবুক।
ফ্রান্সিস হাউগেন আরও সতর্ক করেছিলেন, বিশ্বজুড়ে একাধিক ভাষায় করা বিভিন্ন পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ফেসবুক।
গত ৫ অক্টোবর ফ্রান্সিস হাউগেন ফেসবুকের সংস্কৃতি নিয়ে বড় ধরনের বোমা ফাটান। মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে হাজির হয়ে তিনি ফেসবুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সব ধরনের শঠতা ও নোংরামির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ২৭০ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর এ সাইটটি মানুষের মধ্যে জেনেবুঝে বাজে খাদ্যাভ্যাস প্রচার করছে। এ ছাড়া গণতন্ত্রকেও ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
ইয়াহু জানায়, হাউগেনের ফাটানো বোমার প্রভাব পড়েছে মেটার আয়ের ওপরে। গত ফেব্রুয়ারিতে বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে মেটা প্ল্যাটফর্ম যে আয় ঘোষণা করে, তা আগের তুলনায় অনেক কম। এ ধাক্কা গিয়ে সরাসরি লেগেছে মার্ক জাকারবার্গের পকেটেও। ২৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছেন তিনি। দুর্বল আয়ের খবর জানাজানি হওয়ার পরদিনই মেটার বাজারমূল্য ২৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পড়ে যায়।
মেটার পক্ষ থেকে যে প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির হাতিয়ার মনে করা হচ্ছিল, সেটিও পড়েছে দুর্বিপাকে। মেটার পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত বছরই তাদের রিয়্যালিটি ল্যাবস বিভাগ ১০ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান করেছে, যা ২০২০ সালের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। রিয়্যালিটি ল্যাবস হলো মেটা প্ল্যাটফর্মের ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটি হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরির প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালে মেটার এ বিভাগটি ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান গুনেছিল। ২০১৯ সালে এর লোকসান ছিল সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মেটার আয় খারাপ হওয়ায় নাখোশ বিনিয়োগকারীরাও। মাঠে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও। সংস্থাটি সম্প্রতি মেটাকে বিনিয়োগকারীদের শেয়ারহোল্ডার প্রস্তাব বিবেচনা করার এবং ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে বলেছে। এতে সম্ভাব্য ঝুঁকি ও নেতিবাচক প্রভাব সম্পূর্ণরূপে না বুঝেই মেটাভার্সের মতো উদীয়মান প্রযুক্তি পরিচালনার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত ডিসেম্বরে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অর্জুনা ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার নাতাশা ল্যাম্ব যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে প্রস্তাবটি দাখিল করেছিলেন। তিনি বলেন, কমিশনের সিদ্ধান্তটি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধরনের জয়। এটি জাকারবার্গের নেতৃত্ব ও মেটাভার্সের মতো প্রযুক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম দ্য স্ট্রিট সাইটকে ল্যাম্ব বলেছেন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের রায়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে মেটাভার্সের মানসিক ও মানবিক অধিকারের বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে। এতে উদীয়মান প্রযুক্তিতে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার লোকসান দেওয়া উচিত কি না, তা বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। কারণ মেটার মূল প্ল্যাটফর্মে ঝুঁকিগুলো ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে ব্যর্থ হচ্ছে বলেও প্রতীয়মান হয়েছে।
মেটার একজন মুখপাত্র বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের মতামতকে আমরা মূল্য দিচ্ছি। মে মাসে আমাদের বার্ষিক শেয়ারহোল্ডার বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।’

বিনিয়োগকারীদের মতামত প্রসঙ্গে মেটার ভাষ্য, তাদের মেটাভার্স প্রচেষ্টা ঠিক পথেই রয়েছে। এ খাতের সম্ভাব্য ঝুঁকি ভালোভাবে বোঝার জন্য বিশ্বজুড়ে অসংখ্য গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের সঙ্গে কাজ করছে মেটা।
বিনিয়োগকারীরা মেটা থেকে জাকারবার্গের ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাবও দিচ্ছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে জাকারবার্গ ভোটিং শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাই এ ধরনের প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ল্যাম্ব বলেন, ‘অ্যান্টি-ট্রাস্ট মামলা থেকে শুরু করে হুইসেল ব্লোয়ার সাক্ষ্য, কংগ্রেসের শুনানিসহ নানাবিধ চাপে রয়েছে মেটা। এ সময় বিনিয়োগকারীদের কথা বলা জরুরি। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে আমরা তা করতে চেয়েছি। এ ছাড়া আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যাতে মেটাকে সাড়া দিতে হবে। আমরা মেটাতে আরও উন্নত শাসনের কথা ছয় বছর ধরে বলে যাচ্ছি এবং বলে যাব।’
যুক্তরাষ্ট্রের ডব্লিউপিআই বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক কেনি চিং বলেন, ‘মেটাভার্সের সুবিধা বা অসুবিধাগুলোর এখনো প্রমাণ মেলেনি। কারণ এটি নতুন ও জটিল প্রযুক্তি। কিছু গবেষণায় এর নেতিবাচক দিক সামনে এসেছে। জানা গেছে, মেটাভার্স অসামাজিক আচরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই মানুষ শেষ পর্যন্ত মেটাভার্সকে গ্রহণ করবে নাকি প্রত্যাখ্যান করবে, তা দেখতে হবে।’