ম্যানগ্রোভ ও সুন্দরবনের কথা/৯

ম্যানগ্রোভ ও সুন্দরবনের কথা/৯

রথীন মন্ডল
Posted on ১৪ নভেম্বর, ২০২১

সুন্দরীর কপাল পুড়ছে

‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা
তোমায় কোথায় দেখেছি, কোন স্বপনের পারা’

রবীন্দ্র সঙ্গীতের এই দুটি কলি সুন্দরীকে দেখলে আপনিও এ ভাবে ভাবতে পারেন। অবশ্যই, সুন্দরবনের সুন্দরীর জন্য। সুন্দরী গাছের কথা বলছি। সুন্দরীরা আজ ভারতীয় সুন্দরবনে বিপন্ন, কিছুটা ভালো অবস্থায় বাংলাদেশের সুন্দরবনে বেঁচে আছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার হল, স্যার বুচানন হ্যমিলটন এই সুন্দরবন থেকে সুন্দরী গাছকে প্রথম বোটানিক্যাল রিপোর্টে প্রকাশ করেন। তাই সুন্দরীর বিজ্ঞান সম্মত নামের শেষে স্যার বুচানন হ্যমিলটন এর নাম যুক্ত। কথিত আছে, হ্যমিলটন সাহেব কিছুদিন বারুইপুরে থাকতেন.
‘তুমি চলে গেলে, কিছু বললে না’। সুন্দরীর সুন্দরবন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু গবেষণা হয়েছে। প্রয়াত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কুমুদরঞ্জন নস্কর (উনি আমার শিক্ষক) ও লেখক কিছু অনুসন্ধান করেছিল। তার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে এইরকম বলা যায়। প্রথমতঃ সুন্দরী কম লবণযুক্ত মাটিতে জন্মায়। মাটিতে লবণের মাত্রা বেশি হলে, এদের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। দ্বিতীয়তঃ বীজের অঙ্কুরোদ্গমের জন্য মিষ্টি জল অবশ্যই দরকার। বেশি লবণ জলে বীজের অঙ্কুরোদ্গম বাধা পায়। চারাগাছ শুকিয়ে যায়। বীজের এই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। ক্রমশঃ কলকাতা শহরের পরিসর বৃদ্ধির জন্য সুন্দরবনের নদীগুলির উপরিভাগের স্রোত প্রধান নদীর (হুগলী নদী) থেকে বিচ্ছিন্ন, ফলে উপরিভাগের মিষ্টি জল এই নদীগুলিতে আর আসে না। নদীগুলির জলের লবণের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। শুধুমাত্র বর্ষার জলে নির্ভর করে লবনের পরিমাণ কমে না। সুন্দরীর তাই অপমৃত্যু। কলকাতা মেট্রো খননের সময় সুন্দরীর প্রচুর রেণু মাটির নিচ থেকে পাওয়া গেছে। অনুমান করা যায়, কলকাতা এক সময় সুন্দরীর ঘন বনভূমি ছিল।
সুন্দরী বড় গাছ। সোজা বাড়তে থাকে। খুব একটা ডালপালা হয় না। গুড়ি বড় হয়। আলম্ব বা ঠেকা মূল (বাত্রেস রুট) মাটির কিছুটা উপরে কাণ্ড থেকে বের হয়ে নীচের দিকে প্রসারিত হয়। মনে হবে মাটির কাছাকাছি কাণ্ডটার এক বা দুই দিক বেশ কিছুটা চওড়া হয়ে গেছে। এদেরও শ্বাসমূল থাকে। শ্বাসমূলগুলো চ্যপটা ও ঢেউ খেলানো। গাছের চারদিক থেকে বেরিয়ে এরা মাটির উপরে অনেকখানি জায়গায় ছড়িয়ে থাকে। এই শ্বাসমূলগুলো খুব শক্তপোক্ত হয়। এদের গৌণ বিভাজন হয়, তাই উড গঠন হয়ে থাকে। এদের পাতা চামড়ার মতো খসখসে, টক করে ভেঙে যায় না। কাণ্ড বেশ শক্ত গুঁড়িযুক্ত। ছালের ভিতরের দিকটা লালচে-বাদামি রঙের হয়।
সারা পৃথিবীতে দুই প্রজাতির সুন্দরী আছে। সুন্দরবনে একটি প্রজাতি আছে। ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও ওড়িশার ভিতরকনিকায় দুইটি প্রজাতি পাওয়া যায়। পাঠানখালি কলেজ, সুন্দরবনের বাগানের ভিতরে অন্য প্রজাতির গাছটি লাগানো হয়েছে। এটি এখন ফুল ও ফলে পরিণত গাছ। দুই প্রজাতির সুন্দরীর ফুল প্রায় একই রকম দেখতে হয়, কিন্তু এদের ফলের আয়তন ভিন্ন, আবার আকৃতি একই রকম। সুন্দরবনের সুন্দরীর ফলের আয়তন ছোট। সুন্দরীর গাছ ফুল ও ফলে ভরে যায়। মৌমাছি ও কীটপতঙ্গরা পরাগ যোগ ঘটায়।
অনুমান করা যায়, সুন্দরী মিষ্টি জলে হওয়ার ফলে সুন্দরবনের উপরিভাগে বিস্তারলাভ করেছিল। এর শক্তপোক্ত কাঠের জন্য সুন্দরবনের মানুষ একসময় সুন্দরীকে ব্যাপকভাবে কেটে নিজেদের গৃহস্থলির কাজে ব্যবহার করেছে। বন সংস্কার করার সময় এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের এই দুটি লাইন প্রাসঙ্গিক ও সাঙ্কেতিক। অভিমানী সুন্দরীর সুন্দরবন থেকে শেষ বিদায়ের কথা। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে ………..তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে’। কিন্তু সুন্দরীর নাম সুন্দরবনের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত, তাকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। প্রয়াত বিজ্ঞানী নস্কর তাঁর বারুইপুরের বাড়ির উঠানে সুন্দরীর চারাগাছ লাগিয়েছিলেন, সেগুলো এখন মহীরুহ, ফুলে, ফলে দৃশ্যমান। এটি একটি শিক্ষণীয় বিষয় যে, আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সুন্দরীকে আবার বিকশিত করে তুলতে পারে।
সুন্দরবনে সুন্দরীর অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। ‘একে তো বিভীষণ শত্রু, তাতে সুগ্রীব দোসর’। এমনিতেই সুন্দরবনে মিষ্টি জলের সংকট, তাতে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র জলের উপরিতলের বৃদ্ধি ও তার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্লাবনের সম্ভাবনা। সুন্দরীর অন্তর্জলি যাত্রা আসন্ন। এমতাবস্তায় সুন্দরীর সংরক্ষণের জন্য কিছু উপায় আলোচনা করা হল। ১) সুন্দরীর পরিণত বীজ সংগ্রহ করে বিশেষ ব্যাবস্থার মাধ্যমে এদের অঙ্কুরোদ্গম করাতে হবে। ২) অঙ্কুরিত বীজ গ্রামের ভিতর লাগাতে হবে। ৩) এই কাজের জন্য গ্রামের মানুষের সহায়তা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ৪) গ্রাম্য প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যুক্ত করতে হবে। ৫) সর্বোপরি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
বাংলার জনপ্রিয় এক লোকগীতির কথার অনুকরণে ও গানে, সুন্দরীর সংরক্ষণের প্রচার জরুরি। “না না সুন্দরীকে ছেড়ে দেব না,
একবার সুন্দরী চলে গেলে,
আর তো তাকে সুন্দরবনে ফিরে পাব না।
“না না সুন্দরীকে ছেড়ে দেব না,
যাব আমি সুন্দরবনের কুলে কুলে,
বসাবো তারে নদীর কোলে।।
না না না সুন্দরীকে ছেড়ে দেব না।”
(চলবে)