ম্যানগ্রোভ মাহাত্ম্য

ম্যানগ্রোভ মাহাত্ম্য

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ এপ্রিল, ২০২৫

প্রতিবছর ম্যানগ্রোভ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির ৭০০ বিলিয়নেরও বেশি কিশোর মাছ ও অমেরুদন্ডী প্রাণী লালন পালন করে। যথা চিংড়ি, মাছ, কাঁকড়া, আনুমানিক ২০৭ কোটি মানুষ বর্তমানে সামুদ্রিক মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ম্যানগ্রোভে রয়েছে মাছেদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর বাস্তুতন্ত্র । গ্রীষ্ম মন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় উপকূলের জোয়ার-ভাঁটা অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ কাঠামো ছোট মাছ এবং শামুক প্রজাতির জন্য আশ্রয় এবং খাদ্য সরবরাহ করে। অনেক প্রজাতির লালনগৃহ এইসব ম্যানগ্রোভ। ক্ষুদ্র এবং রপ্তানিযোগ্য মাছ, কাঁকড়া এবং চিংড়ির চাষ বেশ লাভজনক। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি প্রজাতির তথ্য একত্রিত করেছেন। বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ৪৮১টি পরিসর থেকে তথ্য এসেছে। যদিও পশ্চিম আফ্রিকার মতন কিছু অঞ্চলে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব রয়েছে। এই ব্যবধান পূরণের জন্য গবেষকরা ‘ডেলফি’ কৌশলে প্রজাতি ঘনত্বের পরিবেশগত চালিকাশক্তিগুলিকে সনাক্ত করেছেন। বারোটি পরিবেশগত পরিবর্তনের ভবিষ্যৎবাণী করার জন্য তাঁরা মডেল তৈরি করেছেন – সমুদ্রপৃষ্ঠের লবণাক্ততা, জোয়ারের প্রশস্ততা, ম্যানগ্রোভ এলাকা এবং প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা। মডেলটি ম্যানগ্রোভ প্রান্তের দৈর্ঘ্য, বনের বিস্তৃতির পরিবর্তনকেও বিবেচনার মধ্যে আনে। সারা বিশ্বের ভূ-স্থানিক স্তর ব্যবহার করে, গবেষকরা পরিচিত ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে প্রজাতির ঘনত্ব অনুমান করার চেষ্টা করেছেন। কোন ম্যানগ্রোভে সর্বোচ্চ জীবন প্রাচুর্যের সমাহার রয়েছে, তাও পরিকল্পনা করতে সক্ষম এই মডেল। ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার লোহিত সাগর, ক্যারিবিয়ান এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলের মূল অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অঞ্চলগুলি ব-দ্বীপীয় উচ্চ ঘনত্বের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। বিশ্বজোড়া জীব বৈচিত্রের প্রায় অর্ধেকই রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এই অঞ্চলে, মাছ এবং চিংড়ির সংখ্যা প্রাধান্য পেয়েছে। কেবলমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই বার্ষিক ১৮৫ বিলিয়ন চিংড়ি উৎপাদন হয়। তাছাড়া মায়ানমার, মালয়েশিয়া, এবং পাপুয়া নিউ গিনি প্রভৃতি দেশগুলিও উচ্চস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা এবং কলম্বিয়ার দুটি কাঁকড়া প্রজাতি ইউসিডে কর্ডাটাস এবং ইউসিডে অক্সি ডেন্টালিস উচ্চমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। এইসব কবচি প্রাণীর সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। ম্যানগ্রোভ লালনক্ষেত্রগুলির উপর নির্ভরশীল তিনটি পেনাইড চিংড়ির প্রজাতি ঘনত্ব পাকিস্তান, ভারত, মায়ানমার এবং ভিয়েতনামের মতন জায়গায় বেশি। বিপরীতে, আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে বড় ঝিনুকের ঘনত্ব অনেক বেশি। লাল ম্যানগ্রোভ মূলের আবাসক্ষেত্রর সাথে ঘনিষ্ট ভাবে জড়িত এই প্রজাতিটির অবদান আঞ্চলিক মৎস্য চাষে ব্যাপক। পুষ্টিগুণ এবং জোয়ার ভাটার ক্রিয়া-কলাপ সমৃদ্ধ ব-দ্বীপীয় ম্যানগ্রোভগুলি সর্বাধিক প্রাচুর্যকে ধরে রেখেছে। অন্যদিকে খন্ডিত ম্যানগ্রোভ অঞ্চল বা দীর্ঘ প্রান্তীয় অঞ্চলগুলিতে কখনো কখনো উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে। মাছের মূল অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে আমাজনের পূর্বে ব্রাজিলের বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ উপকূলরেখা, ভেনিজুয়েলার অরিনাকো ডেলটা, সেই সাথে কলম্বিয়া এবং মেক্সিকো ব-দ্বীপীয় এবং উপ-হ্রদীয় ক্যারিবিয়ান উপকূল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চল যেমন মেকং বদ্বীপে ‘মাছের প্রাচুর্য’ এবং ‘মাছ ধরার চাপ’ এই দুয়ের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক দেখা গেছে। এই অঞ্চলে, মাছের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বহু ছোটো মৎস্যশিকারী উভয়ই রয়েছে। বিপরীতে, উত্তর লোহিত সাগরের মতন স্থানগুলিতে উচ্চ উৎপাদনশীলতা দেখা গেলেও মৎস্যশিকারীদের সংখ্যা অনেক কম। কিছু কিছু দেশে আবার মৎস্যশিকারীদের সংখ্যা বেশি অথচ মাছের প্রাচুর্য কম। এই অমিলটা অতিরিক্ত মাছ ধরা বা মাছের আবাসস্থলের অবনতিকে নির্দেশ করে। অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের কিছু অংশসহ অন্যান্য অঞ্চল জীবিকা নির্বাহ, বাণিজ্যিক মৎস্য চাষের পরিবর্তে বিনোদনমূলক মৎস্য চাষকে উৎসাহিত করে। ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রাজিলের মতন দেশে ম্যানগ্রোভ, বনজ খাদ্য ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। কিন্তু সীমিত ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের দেশ যেমন জাপান বা পেরুতে উচ্চ সামুদ্রিক খাবার উৎপাদনে তাদের ভূমিকা লক্ষণীয়। ম্যানগ্রোভ স্থানীয় অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে কর্মসংস্থান যোগায়। পরিবেশের সংকটের বিরুদ্ধে প্রহরী হিসেবে কাজ করে। দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলিতে মৎস্য চাষকে কেন্দ্র করে ৮০ শতাংশ প্রজাতি তাদের জীবন চক্রের মধ্যে কিছু সময় ম্যানগ্রোভের উপরেই নির্ভর করে। এই গবেষণা ম্যানগ্রোভকে ‘গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো’ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য উৎসাহিত করে। উপসংহারে গবেষকরা জানান ” স্পষ্টতই বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছ এবং অমেরুদন্ডী প্রাণী প্রজাতির প্রাচুর্য, ম্যানগ্রোভের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়। “

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + 19 =