
বিশ্বজুড়ে ‘রাক্ষস ফুল বা শব ফুল’ নামে কুখ্যাত অরাম টাইটান ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। সুমাত্রার স্থানীয় এই দৈত্যাকৃতি ফুলটি মূলত আবাসস্থল ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন ও আক্রমণাত্মক প্রজাতির কারণে বিপন্ন তালিকায় উঠে এসেছে। নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও শিকাগো বোটানিক গার্ডেনের নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে, এই ফুলের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক নথিরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বিশ্বের বিভিন্ন বোটানিক গার্ডেন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত শব ফুলের বংশতালিকা বিশ্লেষণ করেছেন। দেখা যায়, তথ্য সংরক্ষণে বিশাল ফাঁক রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ বংশতালিকা না থাকায় সঠিক প্রজনন পরিকল্পনা তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ছে। দেখা যায়, ২৪% ক্ষেত্রেই এই ফুল ক্লোন-করা। অর্থাৎ জীব, কোষ, বা ডিএনএ-এর জিনের অভিন্ন নকল। আর ২৭% এসেছে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় উদ্ভিদের সংকরায়ন মারফত। গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক অলিভিয়া মুরেল বলেন, “জিন বৈচিত্র্য কমে গেলে গাছের সামগ্রিক সক্ষমতা হ্রাস পায়। আত্মীয় সংকরায়ণ ঘটলে অনেক সময় গাছ যথেষ্ট পরিমাণে পরাগ উৎপন্ন করতে পারে না কিংবা ফুল ফোটার পরপরই মারা যায়। এক প্রতিষ্ঠানে এমনকি দেখা গেছে, সব সন্তানগাছ রঞ্জক পদার্থহীন বা অ্যালবিনো হওয়ায় তারা বেঁচে থাকতে পারেনি।” রাক্ষস ফুলের কুখ্যাত নামটি এসেছে ফুল ফোটার সময় এর গা থেকে বেরোনো মৃতদেহ সদৃশ দুর্গন্ধ থেকে, যা মাছি ও পচনভোজী পোকাকে আকৃষ্ট করে। এই ফুলের প্রস্ফুটন বিরল ও স্বল্পস্থায়ী। মাত্র ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা এরা বেঁচে থাকে। ফলে বোটানিক গার্ডেনগুলোতে এটি দর্শকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু । এটি “বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ” শ্রেণিভুক্ত। এর বীজ শুকানোর পর জীবক্ষম থাকে না বলে সেগুলোকে বীজ রক্ষণাগারে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। ফলত, সারা বিশ্বে ‘শব ফুল’ সংরক্ষণ করা হয় জীবন্ত উদ্ভিদ হিসেবে গবেষণাগার, বোটানিক গার্ডেন ও উদ্ভিদালয়ে। তবে প্রজননে বড় বিপত্তি হলো এর ফুল ফোটার সময়সীমা। স্ত্রী ফুল প্রথমে ফোটে, পুরুষ ফুল ফোটে পরে । ফলে স্বাভাবিক পরাগায়ণ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় সংরক্ষণবিদরা বাধ্য হয়ে একই উদ্ভিদের পূর্ববর্তী ফুলের পরাগ ব্যবহার করেন, যা আত্মীয় প্রজননের ঝুঁকি বাড়ায়। মুরেল প্রায় ১,২০০ উদ্ভিদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন ১১১টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। সেইসব হাতে লেখা নোট, সারণি বা এলোমেলো তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশ তথ্য অসম্পূর্ণ। উদ্ভিদের উৎস, পরাগদাতা বা প্রজননের ইতিহাস প্রায় লিপিবদ্ধই হয়নি। বিশেষত এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে গাছ স্থানান্তরিত হওয়ার সময় নথি হারিয়ে যায়। ডিএনএ পর্যায়ক্রম বিশ্লেষণ করে ৬৫টি উদ্ভিদের জিন বৈচিত্র্য পরীক্ষা করে গবেষক দলটি নিশ্চিত হয় যে সব সংগ্রহশালাতেই জিন বৈচিত্র্য কম, আত্মীয় প্রজননের হার বেশি। বর্তমানে বন্য পরিবেশে মাত্র ১৬২টি শব ফুল বেঁচে আছে। সংখ্যাটি সংরক্ষণ কার্যক্রমে আশু পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে। মুরেল বলেছেন, “প্রজাতিটির টিকে থাকার জন্য বৈচিত্র্য দরকার। যদি কিছু না করা হয়, আত্মীয় প্রজননের কারণে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হতে পারে। তাই মানসম্মত ও কেন্দ্রীয় উপাত্ত সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” গবেষক দলটি পাঁচটি সুপারিশ করেছে: ১. বন থেকে সংগৃহীত প্রতিটি উদ্ভিদের উৎস ও পিতামাতার তথ্য লিপিবদ্ধ করা, ২. সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথ্য মানসম্মত করা, ৩. জন্মদাতৃ গাছের ইতিহাস রাখা, ৪. উদ্ভিদ স্থানান্তরের সময় তার নথি স্থানান্তর নিশ্চিত করা, ৫. সবার জন্য অভিন্ন রেকর্ডিংএর ভাষা ও সংজ্ঞার্থ তৈরি করা। এই সুপারিশগুলি বাস্তবায়িত হলে শুধু শব ফুল নয়, অন্যান্য বিরল উদ্ভিদেরও জিন বৈচিত্র্য সংরক্ষণ সহজ হবে, যা ভবিষ্যতে প্রকৃতিতে পুনঃপ্রবর্তনের পথ প্রশস্ত করবে।
সূত্র :“Using pedigree tracking of the ex situ metacollection of Amorphophallus titanum (Araceae) to identify challenges to maintaining genetic diversity in the botanical community” by O G Murrell, Z Diaz-Martin, K Havens, M Hughes, A Meyer, J Tutt, N Zerega and J B Fant, 3 April 2025, Annals of Botany.