তার অনেক পরিচয়। তিনি পৃথিবীর সেরা জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন লেখক। তিনি ছিলেন পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সাংসদ। দূর্নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে তীব্র আন্দোলন করা ছিল তার সহজাত স্বভাব। এছাড়াও তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম অর্থনীতির সংস্কারক এবং দেশের সিভিল সার্ভিসের প্রধান।
তিনি রিচার্ড লিকি। কিনিয়ার নাইরোবিতে তার জন্ম ১৯৪৪-এ। মারা গেলেন গত ২ জানুয়ারী। তার কয়েকদিন আগেই পালিত হয়েছে তার ৭৭তম জন্মদিন। বাবা লুইস ও মা মেরি, দুজনেই ছিলেন বিখ্যাত প্রত্নতত্ববিদ। তাই হয়ত লিকির প্রথম প্রেম হয়েছিল জীবাশ্ম চর্চা। ২০ বছর বয়েসেই লিখে ফেলেছিলেন একাধিক বই! প্রত্নতত্ব, মানবসভ্যতার ইতিহাস এবং বন্য প্রাণীদের ইতিহাস, জীবনচর্চা, তাদের সংরক্ষণ ছিল লিকির মূল বিষয়বস্তু। এর মধ্যে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ পরবর্তীকালে লিকিকে কিংবদন্তি বানিয়েছিল। সারাজীবন এত রকমের কাজ তিনি করেছেন। কিন্তু বন্য প্রাণীদের জন্য কিনিয়ায় তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৮০-র দশকের শেষদিকে লিকির জীবনযাত্রায় এসেছিল বড় পরিবর্তন। তিনি যোগ দেন কিনিয়ার ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিসে (কেডব্লিউএস)। এমন একটা সময় যখন সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে! আর কিনিয়া জুড়ে হাতি শিকারীদের দাপট বাড়ছে। কিনিয়া জুড়ে হাতি আর গন্ডার তখন বিলুপ্তির পথে! শিকারীদের হাতে হাতির দাঁত আর গন্ডারের খড়গ সেই সময় অবাধে চোরাকারবারি হচ্ছে। অদম্য লিকির সংঘাত শুরু হয় চোরাকারবারিদের সঙ্গে। বনদফতরের নিরাপত্তাকর্মীদের তার নির্দেশ ছিল চোরাকারবারিদের দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলার। করেওছেন সেটা। একইসঙ্গে বিশ্বের নজর টানার জন্য লিকি আরও একটা কাজ করেছিলেন। কয়েক হাজার মৃত হাতির দাঁত উদ্ধার করে সেগুলোকে এক জায়গায় জড় করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন! কাজটা করার আগে খবর দিয়েছিলেন দেশের প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যম আর কয়েক হাজার সাধারণ মানুষকে।
লিকির এই আন্দোলনে কিনিয়ার জঙ্গলে শেষপর্যন্ত বন্ধ হয়েছিল হাতি আর গন্ডারের চোরাশিকার ও চোরাকারবারি। বিলুপ্ত হয়নি দুই প্রাণী। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গলে অনেক শত্রু তৈরি হয়েছিল রিচার্ড লিকির। ১৯৯৩-এ একটি সিঙ্গল-ইঞ্জিন বিমানে চেপে যাওয়ার সময় লিকি বিরাট এক দূর্ঘটনায় পড়েছিলেন। দূ’টো পায়েই হাটুঁর নীচ থেকে সম্পূর্ণটা বাদ চলে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল লিকি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন।
তার পরের বছরই, ১৯৯৪-এ লিকি রাজনীতিতে যোগ দেন কেডব্লিউএস ছেড়ে। সাফিনা নামের এক রাজনৈতিক দল তৈরি করেন এবং নির্বাচনে জিতে বিরোধী দলের সাংসদও হয়েছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে তার উল্লেখযোগ্য কাজ দেশের দূর্নীতির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। তার ফলও ভাল হয়নি। অনেক শত্রু তৈরি হয়। লিকি রাজনীতিকে বিদায় জানান ২০০১-এ।
২০১৫ সালে আবার লিকিকে ফেরানো হয় কেডব্লিউএসের বোর্ডের চেয়ারম্যান করে। তিনি যখন কিনিয়ার এক বিখ্যাত প্রত্নতাত্বিক অঞ্চল রিফট ভ্যালিতে থাকছিলেন। তার বাবা-মা-ও প্রায় সারাজীবন রিফট ভ্যালিতে কাটিয়ে দিয়েছেন। রিকির উদ্যোগেই ২০১৫-য় নাইরোবি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে রেললাইন তৈরি করে হয়েছিল। বিশাল ওই জাতীয় অরণ্যে প্রত্যেকটি প্রাণীর যত্ন নিতে তাদের কাছে পৌঁছতে দ্রুত পৌঁছতে হত। সেই উদ্দেশে রেললাইন তৈরি করেছিলেন লিকি।
কিন্তু প্রাণীদের সংরক্ষণের চিন্তা করতে করতেই আন্তর্জাতিক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ড পাওয়া রিচার্ড লিকি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে। ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “মানুষের তৈরি বিশ্ব উষ্ণায়নে একদিন কিনিয়ার ন্যাশনাল পার্কগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!”
রিচার্ড লিকির স্বপ্ন ছিল দেশের রিফট ভ্যালিতে একটা জাদুঘর তৈরি করা। যেখানে সংরক্ষিত থাকবে কিনিয়ার মানুষের ইতিহাস, তাদের জন্মকথার ইতিহাস। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরা থেকে গেল!