রোগীদের ওষুধ পাঠানো এক যুবকের স্মরণীয় লড়াই!

রোগীদের ওষুধ পাঠানো এক যুবকের স্মরণীয় লড়াই!

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা‌।
Posted on ১৩ আগষ্ট, ২০২২

প্যারিসের অরলে বন্দরের রানওয়ে ছুঁয়েছে পাকিস্তানের বোয়িং ৭২০বি বিমান। যাত্রী-সহ বিমানে থাকা প্রত্যেকে নামার জন্য প্রস্তুত। ঠিক এই সময়েই বিমানে উঠে পড়লেন ২৮ বছরের এক যুবক। একহাতে পিস্তল, অন্য হাতে একটি ব্যাগ। যাত্রীরা ভয়ে কাঠ। পাইলটের হাত দিয়ে নিজের দাবিপত্র বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিলেন আততায়ী। তারপর পুলিশের হাতে তার আত্মসমর্পণে নাটকের শেষ।
দিনটা ছিল ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর। সেদিনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে পাক বাহিনীর। বাংলাদেশের অসংখ্য বস্তিতে, ভারতের বুকে অসংখ্য শরণার্থী শিবিরে কোনওক্রমে বেঁচে ছিলেন অসংখ্য বাঙালি। প্রায় সারা দেশ ঘিরে ফেলেছে পাক বাহিনী। শিবিরে শিবিরে ছড়িয়ে পড়েছে কলেরা, টাইফয়েড। প্রায় এক মহামারীর চেহারা নিয়েছে।
সেইদিনই এক অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের শপথ নিলেন এক ফরাসি যুবক। তার নাম জাঁ কাই। ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। বিমান হাইজ্যাক করার উদ্দেশ্য লেখা ছিল জাঁ কাইয়ের দাবিপত্রে। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, অবিলম্বে যাত্রীদের নামিয়ে নিতে। আর তারপর তিনি এই বিমান অপহরণ করে নিয়ে যাবেন বাংলাদেশে। কারণ এই জাহাজের ডিকিতেই আছে ২০ টন ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম। পাকিস্তান থেকেই ফ্রান্সে এসেছে এইসমস্ত ওষুধ। কাই সেই ওষুধ পৌঁছে দেবেন কলেরা-টাইফয়েডে মরতে থাকা বাঙালি রোগীদের!
লড়াই বেশিক্ষণ চালাতে পারেননি জাঁ কাই। সকাল ১১:৫০-এ বিমান অপহরণের চেষ্টা করেন তিনি। সেদিন বিকেলের মধ্যেই অবশেষে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন তিনি। যে ব্যাগে বিস্ফোরক আছে বলে সন্দেহ করেছিল পুলিশ সেখান থেকে বেরিয়েছিল একটি বাইবেল এবং দুটি ডিকশনারি। বাংলাদেশে এসে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এই ডিকশনারি কাজে লাগত। জাঁ কাইয়ের সাহসিকতা দেশে অবাক হয়েছিল সারা বিশ্ব। আর অবাক হয়েছিল বহুদূরে বাংলাদেশের অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা দেখে। বিচারে শেষ পর্যন্ত অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁকে একজন মানবতাবাদী নায়ক হিসাবেই মনে রেখেছে ইতিহাস। আর তাঁর দাবি মেনেই সেই ২০ টন ওষুধ বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন ফ্রান্স সরকার। প্রত্যেকের কাছে সেই ওষুধ বণ্টনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ফ্রান্সের রেডক্রস সোসাইটি। ৫ বছরের কারাবাসের মেয়াদ শেষে যেদিন মুক্তি পেলেন জাঁ কাই, সেদিন আবারও প্যারিসের রাজপথে ভেঙে পড়েছিল মানুষের ভিড়। জাঁ কাই প্রয়াত হন ২০১২-তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 5 =