লিগনিন থেকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদন

 লিগনিন থেকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

বিশ্বজুড়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাশ্রয়ী এবং দক্ষ হাইড্রোজেন উৎপাদন প্রযুক্তি তৈরি করা। এক্ষেত্রে নতুন আশার আলো দেখিয়েছেন শেনইয়াং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি ও গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির গবেষকেরা। তাঁরা কাগজশিল্পে উৎপন্ন সস্তা বর্জ্য উপাদান লিগনিন ব্যবহার করে এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অনুঘটক তৈরি করেছেন। এ অনুঘটক জলবিদ্যুৎভিত্তিক হাইড্রোজেন উৎপাদনের যা কঠিনতম ধাপ সেই অক্সিজেন ইভোলিউশন রিঅ্যাকশনকে (ও ই আর) উল্লেখযোগ্যভাবে আরও দ্রুত ও স্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

গবেষণাটি বায়োচার এক্স–এ প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, নতুন অনুঘটকটি লিগনিন থেকে তৈরি কার্বন তন্তুতে নিকেল অক্সাইড (NiO) ও আয়রন অক্সাইড (Fe₃O₄) ন্যানোকণা খচিত উপাদান। মাত্র ২৫০ মিলিভোল্ট অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক চাপে ১০ mA/cm² বৈদ্যুতিক ঘনত্বে কাজ করতে পারে এবং উচ্চ কারেন্টে টানা ৫০ ঘণ্টার বেশি স্থিতিশীল থাকে। শিল্পমানের ইলেক্ট্রোলাইজারে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত এ এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

এসব কর্মক্ষমতা সাধারণত ব্যয়বহুল প্লাটিনাম–গ্রুপ ধাতুর অনুঘটকে দেখা যায়। ফলে এই বায়োমাস-উৎপন্ন বিকল্পটি শিল্পের জন্য আরও সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে উঠে আসতে পারে। লিগনিন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচুর্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পলিমার হলেও এর শিল্পোৎপাদিত বেশিরভাগ অংশই কম দক্ষতা পর্যায়ে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে ফেলা হয়। গবেষকেরা ইলেক্ট্রোস্পিনিং ও তাপপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই লিগনিনকে পরিবাহী ও শক্তিশালী কার্বন তন্তুতে রূপান্তর করেছেন। এসব তন্তু শুধু যে ধাতব ন্যানোকণার জন্য স্থিতিশীল অবলম্বন তাই নয়, উপরন্তু বিক্রিয়ার সময় দ্রুত ইলেকট্রন চলাচল নিশ্চিত করে। ফলে গঠিত হয় NiO/Fe₃O₄@LCFs—একটি নাইট্রোজেন–মিশেল দেওয়া কার্বন কাঠামো। এটি দ্রুত চার্জ পরিবহন, বড় সক্রিয় পৃষ্ঠ ও উচ্চ কাঠামোগত স্থায়িত্ব দেয়।

আণুবীক্ষণিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিকেল ও আয়রন অক্সাইড ন্যানোকণাগুলো কার্বন তন্তুর ভেতরে সূক্ষ্ম ‘ন্যানোস্কেল হেটারোজাংশন’ তৈরি করে। দুটি ভিন্ন ধরনের অর্ধপরিবাহী পদার্থের মধ্যে তৈরি হওয়া সংযোগস্থলের এই বিশেষ সংযোগই ও ই আর–এর গতি বাড়িয়ে দেয়। কারণ এটি প্রতিক্রিয়ার মধ্যবর্তী অণুগুলোকে ঠিক মতো আবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন হতে সাহায্য করে। পাশাপাশি কার্বন নেটওয়ার্ক ন্যানোকণার জমাট বেঁধে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে – যা প্রচলিত ধাতব অনুঘটকগুলির এক সাধারণ দুর্বলতা।

ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, দ্বি-ধাতু এই উপাদানটি এক-ধাতু অনুঘটকের তুলনায় অনেকটা কার্যকর। এর প্রতিক্রিয়ার গতি-ঢাল মাত্র ১৩৮ mV/dec, যা দ্রুত বিক্রিয়াগতির নির্দেশক। রমন বর্ণালীবীক্ষণ ও ডেনসিটি ফাংশনাল থিওরি/ ইলেকট্রন ঘনত্বভিত্তিক গণনা তত্ত্বের হিসেবও নিশ্চিত করেছে যে প্রকৌশলকৃত স্পর্শ-তলই (ইন্টারফেস) এর উচ্চ কার্যকারিতার মূল উৎস।

গবেষকেরা মনে করছেন, বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন লিগনিনের সহজলভ্যতা এই প্রযুক্তিকে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে নেবে। পুনর্নবীকরণযোগ্য উদ্ভিদ-বর্জ্য থেকে তৈরি অনুঘটক কার্বন কাঠামোর সঙ্গে সস্তা ধাতব অক্সাইডের সমন্বয় ভবিষ্যতের সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদনকে আরও টেকসই, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারে।

 

সূত্র: ‘Paper mill waste could unlock cheaper clean energy’ by Shenyang Agricultural University, 11th December 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =