ভাবুন একবার, সিনেমা হলে ঢুকছেন, দুটি সিনেমা – দুটো’ই অপরিচিত ছবি! কিন্তু টিকিট আগাম কাটা, অগ্যতা দেখা’ই যাক না কী হয় !
সিনেমা ১: ক্লড লেফিংওয়েল, শিকাগোর প্রতিষ্ঠিত এক মাংসব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত জীবনে বহু নারীতে তাঁর আসক্তি। হঠাৎ করে’ই সিফিলিস্ রোগে সে আক্রান্ত হয়। তাঁর স্ত্রী আনা স্যুলজ্ এসব কিছুই জানতেন না। আনা ও ক্লডের এক পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। প্রথমে বাবা-মা বুঝতে পারেনি, যে তাঁদের সন্তান শারীরিকভাবে গুরুতর প্রতিবন্ধী। ডান কান’টি প্রায় নেই, ঘাড়-গলা প্রায় বসে গেছে। গায়ের ত্বকে বিভিন্ন রঙের ছোপ। ছুটে যান চিকিৎসক ডাঃ হেইসেলডেন-এর কাছে। চিকিৎসক কোনোরকম অস্ত্রপ্রচারের পথে না-হেঁটে বাবা-মা’কে সরাসরি জানিয়ে দেয়, এই শিশুকে মেরে ফেলা’ই দরকার। কারণ সে কোনোদিন’ই সুস্থ হবে না এবং বিশ্বজোড়া ‘সুস্থ’ বাচ্চাদের কাছে নিরন্তর উপহাস-বিদ্রুপের শিকার হয়ে কীভাবে – কতদিন বাঁচতে পারবে ? এই অপমানজনক ‘মৃত্যু’-র থেকে শিশুকে রক্ষা করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব। ক্লড-আনা সম্মতি দেয়। চিকিৎসক শিশুটিকে খুন করে।
সিনেমা ২:বার্লিনের বিখ্যাত ডাক্তার এবং অধ্যাপক টমাস হেইত। স্বচ্ছল-স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাঁর স্ত্রী পরমাসুন্দরী ‘হান্না’। দু’জনের দুর্দান্ত রোম্যান্স – কিন্তু বারেবারে সন্তান-প্রসবে সমস্যা – মিসক্যারেজ ! খাঁটি ‘আর্য’ জার্মান দম্পতির অনেক চেষ্টা’ই বিফলে যেতে থাকে। হঠাৎ ‘হান্না’ তাঁদের দশম বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে বিচিত্রভাবে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়, । প্রথমে অজ্ঞান – পরে ডানহাতটি প্রায় বিকল – কথা বলার ক্ষমতাও চলে যায়। চিকিৎসকরা জানায়, হান্না ‘মাল্টিপল স্কোলেরোসিস’ নামক স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত। মস্তিষ্ক থেকে সুষুম্নাকান্ড পর্যন্ত সমস্ত অচল হয়ে যাচ্ছে। কোনো সিগন্যাল’ই মস্তিষ্কে সঠিকভাবে পৌঁছোচ্ছে না। খুব দ্রুত হান্নার শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, কথা-বলার-ক্ষমতা লোপ পায়। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ‘হান্না’, ‘টমাস’-কে বলে অবিলম্বে তাঁকে মেরে ফেলতে। টমাস রাজী হয়, আদালতে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন-সহ হান্নাকে নিয়ে সটান হাজির হয়। বিচারপতির টেবিলে আবেদনটি রেখে, মূহুর্তের মধ্যে পকেট থেকে পিস্তল বার ক’রে, সকলের সামনে ‘হান্না’-কে গুলি ক’রে খুন করে। হতবিহ্বল কোর্টরুমে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক টমাস বলতে থাকে, “হান্না অমানবিক কষ্ট পাচ্ছিল – ওর যে রোগ, সেটা থেকে ওকে কোনোভাবে সুস্থ ক’রে তোলা সম্ভব নয় – ওর সন্তানধারণের ক্ষমতা’ও নষ্ট হয়ে গেছে – যদি কখনও সন্তানের জন্ম দিতো, তাহলে এই ‘শয়তান রোগের জিন’ আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রবাহিত হতো – আমার প্রিয়তম স্ত্রী ‘হান্না হেইত’ জার্মান জাতির পক্ষে ‘আনপ্রোডাক্টিভ’ – ও ‘প্রতিযোগিতায় টিকে-থাকার লড়াই’-য়ে হেরে গেছে।’’
প্রথম সিনেমা’টি ‘দ্য ব্ল্যাক স্টর্ক’ (The Black Stork) । একটি নির্বাক সাদাকালো ছবি – তৈরি করা হয়েছিল ১৯১৭ সালে, আমেরিকায়। ১৯২০ সালে, এই সিনেমাটির নাম বদলে রাখা হয় – ‘Are you fit to marry’ । গোটা আমেরিকার শতাধিক সিনেমা-হলে ৭ বছর ধ’রে সিনেমা’টি দেখানো হয়। সিনেমা’টি একটি সত্যি ঘটনার উপর তৈরি। তৈরি করেছিলেন সে-সময়ে আমেরিকার ‘ইউজেনিক্স’ বা ‘সুপ্রজননবিদ্য’-র অন্যতম প্রচারকরা। যাঁদের মধ্যে আমাদের বাংলা নাটকের দৌলতে খুবই পরিচিত ব্যক্তিত্ব ‘হেলেন কেলার’-ও অবশ্যই ছিলেন। সিনেমা’টি দেখানোর আগে ‘বলিষ্ঠ-সুস্থ- অর্যিক প্রজননক্ষম’ মানবজাতি তৈরির আবেদন নিয়ে সিনেমা-হলে বক্তৃতা’ও দেওয়া হতো। আমেরিকার এক বিরাট অংশের চিকিৎসক–জীববিজ্ঞানী–আইনজীবিরা ছিলেন এর মূল প্রচারক।
দ্বিতীয় সিনেমা-র নাম – ‘Ich Klage An’ – ইংরেজীতে তর্জমা করলে – ‘I Accuse’ । এটি’ও সাদাকালো, তবে সবাক ছবি। তৈরি করা হয়েছিল ১৯৪১ সালে, জার্মানিতে। নাজিপার্টির অন্যতম নেতা এবং হিটলারের প্রধান প্রচারসচিব যোশেফ গোয়েবলস্ ছিল এর প্রযোজক। জার্মানির কয়েকশো সিনেমা-হলে’ও এটি নিয়মিত দেখানো হয়। যদিও ১৯৪১-র অনেক আগেই নাজিপার্টির সক্রিয় উদ্যোগে প্রায় ১ লক্ষ ‘খাঁটি’ ‘আর্য’ জার্মান নাগরিকদের খুন করা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, যাঁরা ‘রাষ্ট্র’-র বিচারে ঘোষিত ‘খারাপ জিন’–এর অধিকারী, কারণ হয় তারা মানসিক বা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী অথবা অসুস্থ ! কিন্তু ‘রাষ্ট্র’ নিজে খুন-করার বদলে ‘খাঁটি আর্য জার্মান’-রা যদি নিজেরাই সুস্থ মানুষ তৈরির জন্য উদ্যোগী হয়ে ‘প্রিয়জন’-কে খুন করতে এগিয়ে আসে, তা’হলে ‘ঝক্কি’টাযে অনেক কমে যায়! রাষ্ট্রের আর যা’ই হোক, তখন যে অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজ বাকী ! এটা’ই হল সিনেমা’টি-র মূল বক্তব্য। দীর্ঘ ৬৫ বছর ‘‘নাজি স্বেচ্ছামৃত্যু’-র এই সেলুলয়েড সংস্করণটি ‘নিষিদ্ধ ছবি’ হিসাবে বার্লিনের মাটির তলার সুড়ঙ্গে রাখা ছিল। ২০০৬ সালে ফ্যাসিস্ট সাইটগুলি ইউটিউবে শর্তসাপেক্ষে এটি দেখানো শুরু করে।
যে বিষয়টিকে নিয়ে এতক্ষণের প্রাককথন, তাঁর নাম ‘ইউজেনেটিক্স’ বা ‘সুপ্রজননবিদ্যা’। অনেকে ডারউইনের তত্ত্বের সঙ্গে একে মিলিয়ে মিশিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে ফেলেন। কারণ কোন’টা ঠিক ডারউইনের তত্ত্ব, আর কোন’টা যে তাঁর নয়–বা আদৌ জীববিজ্ঞানের-বিবর্তনবাদের আদৌ অংশ নয়, সে ব্যাপারে এখনও বহু ধাঁধা রয়ে গেছে। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে ডারউইন’কে নিয়ে যত জলঘোলা হয়েছে তার ছিঁটেফোঁটা’ও অন্য কাউকে নিয়ে হয়নি। তাঁর অন্যতম কারণ অবশ্যই বিজ্ঞানীদের একাংশের প্রত্যক্ষ অবদান, শুধু বিজ্ঞানী’ই বা বলবো কেন, বিজ্ঞানী–চিকিৎসকদের প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন দল–ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান–প্রচারমাধ্যম–স্বঘোষিত রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার, কে যে এই গুলিয়ে দেওয়ার খেলায় অংশ নেন নি, তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল।
হিটলারকে সমর্থন জানিয়ে আমেরিকান চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের চিঠি, ১৯৩৩
প্রথমেই পরিষ্কার ক’রে নেওয়া ভালো, ইউজেনিক্স বা সুপ্রজননবিদ্যার জনক কোনোদিন – কোনোভাবেই চার্লস ডারউইন নন। ‘ইউজেনিক্স’ শব্দের জন্ম প্রাচীন গ্রীসে ব্যবহৃত ‘ইউজিনস্’ নামক প্রথা থেকে, যা মানুষের উন্নততর প্রজাতিতে পৌঁছোনোর একটি কাল্পনিক উপায়।
বিশ্ব-রাজনীতি এবং সামাজিক অভিঘাতের ক্যালেন্ডারে–এই ‘ইউজেনিক্স’ শব্দের অর্থ একেবারে’ই পরিষ্কার। বিশেষভাবে মানবপ্রজাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নততর সংস্করণে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বর্তমানে প্রজন্মের ভিতর থেকে পছন্দসই গুনাগুণকে বেছে-নেওয়া। অর্থাৎ মানুষের যৌনমিলন’কে এই তত্ত্ব দুই ভাগে ভাগ করছে। এক, ‘বেছে-নেওয়া’-র মাধ্যমে ‘নির্বাচিত’ নারী-পুরুষের যৌনমিলনে সন্তানের জন্ম দেওয়া। দুই, যাঁরা ‘বাতিল’ গুনাগুণের অধিকারী তাঁদের হয় মেরে ফেলা, অথবা তাঁদের সন্তান-সন্ততিকে’ও নিশ্চিহ্ন ক’রে দেওয়া। এই ‘গুনাগুণ’-কে বেছে নিয়ে কাউকে এগিয়ে রাখা বা কাউকে নিশ্চিহ্ন ক’রে দেওয়া, এই বাছাই-পদ্ধতির নিয়ন্ত্রক কিন্তু মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রয়োজন। এটা কোনোভাবেই প্রকৃতির নিজস্ব জৈবপদ্ধতি নয়। এখানেই ‘ইউজেনিক্স’ তত্ত্ব বারেবারে ধাক্কা দিয়েছে ‘ডারউইন তত্ত্ব’-কে। মজার ঘটনা হলো যারা ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’-কে বিকৃত ক’রে, কখনও ধনীমানুষ-কখনও সাদা-চামড়ার মানুষ-কখনও যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী–কখনও বড়ো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীই কেবলমাত্র পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রন করার অধিকারী বলে (survival of fittest) প্রচারে নেমেছে, তাঁরা কিন্তু সকলেই স্বঘোষিত ‘ডারউইনবাদী’।
১৮৮৩ সালে ডারউইনের ভাইপো নৃতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস গাঁতো এবং এর কয়েকবছর বাদে ব্রিটিশ দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসার ইউজেনিক্স-এর মস্তিস্কপ্রসূত – যোগ্যতমের উদ্বর্ধণ থেকে দ্রুত ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’ (Social Darwinism)-র বিচিত্র তত্ত্ব এবং প্রয়োগ গোটা বিশ্বে ঝড় তুলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে ডারউইন’কে ‘অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত’ প্রচারের আবহেই বেশী মানুষ চেনে। সেটাও প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের দৌলতেই।
যেটা শুরু হয়েছিল ব্রিটেন থেকে, সেটা দ্রুত ছড়িয়ে যায় আমেরিকাতে’ও। ব্রিটিশ ধনকুবের-রাণীসাম্রাজ্যের অধীশ্বর’রা বিশ্বাস’ই করতে শুরু করেন, তাঁরা ধনী কারণ তারা গরীবের থেকে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ অনেক এগিয়ে এবং এটাই একমাত্র ‘সত্যি’। ধুয়ো তুলে এগিয়ে আসেন নামকরা কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও – বিসমার্ক, চেম্বারলীন, রুজভেল্ট স্বয়ং। ডারউইন বিবর্তনবাদের একক হিসাবে যে ‘মানুষ প্রজাতি’-কে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন, এঁরা সেটাকে ভেঙ্গে দিয়ে, বলতে শুরু করলেন, এক মানুষ প্রজাতি ব’লে কিছু নেই – প্রতিটি মানবসংস্কৃতি-চামড়ার রঙ–জাতি–ধর্ম–প্রতিটি’ই আলাদা আলাদা প্রজাতি। সুতরাং সামাজিকভাবে এদের মধ্যে যে ‘শ্রেষ্ঠ’, সে’ই একমাত্র টিকে থাকবে, বা বেঁচে থাকার, বা সন্তান উৎপাদন করার ‘লাইসেন্স’ পাবে। বাদবাকীরা বাতিল !
ডারউইন যেখানে, “সামাজিক জীবনকে বেঁচে থাকার সামগ্রিক আশ্রয় হিসাবে চিহ্নিত করছেন – যেখানে একে অপরকে সাহায্য করা, ভালোবাসা এবং বিপদ থেকে সতর্ক করার গুণাবলীই প্রকৃতির নির্বাচন পদ্ধতিকে সাবলীল ও বলিষ্ঠসূত্রে প্রবাহিত করে,” ব’লে মনে করছেন। সেখানে এই ‘সামাজিক ডারউইনবাদী’-রা যুদ্ধ এবং সংঘর্ষকে’ই মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র ‘লড়াই’ হিসাবে প্রচার ক’রে এসেছে।
যার ভয়াবহ পরিণতি আমরা পাই ১৯৩০’ পরবর্তী অধ্যায়ে নাজিপার্টির কদর্যতম আক্রমণের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে। এখানেও কিন্তু শুরুটা বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানীদের হাত ধ’রেই।
জার্মানির জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এফ.কে. গুনথার-এর ‘মাথার খুলি’ ফর্মুলা
বিশ্বের ইতিহাসে ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিস্ত মনোভাবাপন্ন রাজনীতিকরা কখনওই নিজেদের বিশ্বাস বা কর্মপদ্ধতিকে প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের কাছে উন্মোচিত করে না। কারণ নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনোরকম স্বীকৃতি, তাদের কখনওই থাকে না। ফলে প্রথম পর্যায়ে তারা প্রথিতযশা বিজ্ঞানী–চিকিৎসক–দার্শনিক–সাহিত্যিক, এমনকি কাউকে না-পেলে সিনেমা-নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে যেকোনোভাবে নিজের সামনে জড়ো ক’রে তাদের দিয়ে যাবতীয় মিথ্যা প্রচারকে সংগঠিত করে। এখনকার দিনে অবশ্যই একমাত্র মিডিয়া, কারণ মিডিয়াকে কিনতে পারলে সবধরণের প্যানেলিস্টকে’ই হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়। প্রথমে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। ক্ষমতা দখলের পরেই এদের আসল চেহারা এবং কর্মপদ্ধতি প্রতিবারেই প্রকাশ্যে আসে। হিটলার–মুসোলিনি-ফ্রাঙ্কোর থেকে আজকের পৃথিবী, আজকের ভারত–এমনকি আজকের পশ্চিমবঙ্গ, কোথাও এর বিন্দুমাত্র অন্যথা নেই। ইতিহাস থেকে বর্তমান ক্ষমতা-দখলের ‘প্রাক-নাটক’ একদম এক ! সেজন্য হিটলার যেভাবে ‘ডারউইনবাদী’ – আমাদের দেশে কোনো নেতা সেই একই ফর্মুলায় হয়ে যায় ‘প্রকৃত বামপন্থী’ !
হিটলারের সুবিধা হয়েছিল জার্মানির বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী-চিকিৎসক-প্রকৃতিবিদ আর্নেস্ট হেকেল-এর ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’-সংক্রান্ত বিশদ রূপরেখাকে সামনের মুখোশ হিসাবে প্রকাশ্যে আনায়। প্রথমে প্রচার – হেকেল-এর লেখা জার্মান বই ( Die weltrathsel – The Riddle of the Universe ) শুধু নাজিপার্টি ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে তিন লক্ষ কপি ছাপিয়ে বিক্রি করে, যেখানে প্রথম পাতায় হিটলারের মন্তব্য ছাপা থাকত – “এগিয়ে থাকা জাতি পিছিয়ে পড়া জাতির থেকে অনেক ক্ষিপ্র গতিতে প্রাকৃতিক নিয়মেই বিশ্বের অধীশ্বর হবে। এটাই বিজ্ঞানের মূল সূত্র !” আর প্রতিদিন এই প্রচারে সামিল হত সে সময়কার জার্মানির নামকরা জীববিজ্ঞানী – প্রকৃতিবিজ্ঞানী – নৃতত্ত্ববিদ – চিকিৎসক – অধ্যাপকদের এক বিরাট অংশ। নাটকে – গানে – সিনেমায় – খবরের কাগজে – ছবিতে শুধু এক প্রচার – “এগিয়ে থাকতে কি চাও ? – না পিছিয়ে পড়তে চাও !” দ্রুত সাধারণ শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে –এটাই ‘বোধহয়’ বিজ্ঞান।
পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। প্রচারের অন্তরালে দ্রুত একটার পর একটা জান্তব অধ্যায়।
১) প্রথমে ছিল “সমাজে যারা বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই পিছিয়ে রয়েছে ( Social inferior ) তাদের প্রজননশক্তি বন্ধ ক’রে দেওয়া ‘স্টেরিলাইজেশন’-এর মাধ্যমে।’
২) তারপর ‘জাতিগত শুদ্ধিকরণ ( Racial hygiene )’,
৩) ‘পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠী যাতে ইতিমধ্যেই নির্বাচিত আর্য জিনপুলকে কলুষিত না করতে পারে, সেজন্য তাদেরকে ঘেঁটোয় পুরে রাখা – কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দী ক’রে রাখা’,
৪) ‘বায়োপলিসি – একটি সঠিক জীবজগতের যুদ্ধ, যাতে প্রকৃতির সর্বোৎকৃষ্ট প্রজাতির আর্য জার্মানরা মানুষের সমস্ত পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে পারে, সেজন্য জার্মানির সরকার রাষ্ট্রের যাবতীয় শক্তিকে নিয়োজিত করতে বদ্ধপরিকর।’
এটা তো ছিল ‘নিশ্চিহ্ন’ করার কর্মসূচী। অন্যদিকে সুগঠিত–বলিষ্ঠ–নীলচোখের আর্য জার্মান গোষ্ঠীকে যাবতীয় নোংরা স্পর্শ থেকে রক্ষা করার ব্লু-প্রিন্টও তো চাই। জার্মানির জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এফ.কে. গুনথার-এর নয়া তত্ত্ব নাজিপার্টি শুধু গ্রহণই করল না, এক মাসের মধ্যে গোটা জার্মানিতে তা চালুও ক’রে দিল। কী কী ছিল সেই ‘জৈববিজ্ঞানের’ মস্তিষ্ক-প্রক্ষালক মেশিনে ?
(১) মাথার খুলির গঠন, (২) চোখের নীল রঙ, (৩) উচ্চতা, (৪) চামড়ার হালকা গোলাপি রঙ, – এইসমস্ত প্রেসক্রিপশন মেনে যে জার্মান যুবক বেঁচে থাকার ছাড়পত্র পাবে, তার সাথে ঐ একই গোত্রের যুবতীদের একাধিক যৌন সম্পর্ক গড়তে হবে। এজন্য জার্মানির বিভিন্ন শহরে প্রায় তিনহাজার ‘সঙ্গমকক্ষ’-ও তৈরি করা হয়েছিল। ‘আদর্শ’ গুনাগুণের নারী-পুরুষ একাধিক সন্তানের জন্ম দেবে, যারা হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর একমাত্র ‘নির্বাচিত মানুষ’। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ৮৭ হাজার এইধরণের ‘ত্রুটিহীন’ জার্মান সন্তানের জন্ম হয়েছিল।
এক্ষেত্রে আমেরিকান স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট ওয়াটেনবার্গ-এর বিচিত্র তত্ত্বকেও অন্যতম সংবিধান হিসাবে হিটলার গ্রহণ করে, যাতে বলা হয়েছিল, নারীরা প্রাকৃতিকভাবেই ‘পিছিয়ে’ পড়া একটা অংশ, যাদের ‘পুরুষ-দ্বারা-সুরক্ষিত’ না করতে পারলে তারা অতি অবশ্যই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য। নাজি জার্মানিতে সে কারণে নারীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় অংশগ্রহণ শুধু নিষিদ্ধই ছিল না, এমনকি নাজিপার্টির কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে কোনো নারীকে কখনও রাখা হত না। তাদের কেবলমাত্র ‘ত্রুটিহীন’ সন্তান উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হত, অনেকসময় মহিলারা জানতেও পারত না, কে তার সন্তানদের আসল পিতা ! যদিও এই ‘ত্রুটিহীন’ সঙ্গমের ফলশ্রুতিতে সবসময় ‘ত্রুটিহীন’ সন্তান জন্মাত না, যদি সন্তান বিকলাঙ্গ বা তথাকথিত আর্য জিন অনুযায়ী না হত, মুহূর্তের মধ্যে সেই মা-দের গুলি ক’রে খুন করা হত। কেননা, তাদের শরীরে নিশ্চয়ই পিছিয়ে পড়া জিন বা কলুষিত জৈব গুণ রয়ে গেছে, যা খালি চোখে ধরা পড়েনি।
এই ভয়াবহ নারকীয় ঘটনাবলী চালানো হত ‘ডারউইনের’ নামে। প্রতিটি সেন্টারের নামের তলায় জার্মান ভাষায় লেখা থাকত ‘ডারউইনিয়ান বায়োলজিকাল হাব’ !
‘ডারউইনিয়ান বায়োলজিকাল হাব’- ন্যূরেমবার্গ
ইহুদী-জিপসি-আফ্রিকান, এঁরা সকলেই হিটলারের ‘জৈবরাসায়নিক’ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ছিল–‘ভয়াবহ বেজন্মার বাচ্চা’ ! সুতরাং প্রথমদিকে ঘিরে রাখার কর্মসূচী থেকে স’রে এসে পরের দিকে ‘দ্রুত নিশ্চিহ্ন’ করার পথেই এগিয়ে যায় নাজিপার্টি। যাদের খুন করা হচ্ছে সেই ৬০ লক্ষ মানুষের জন্য ‘ডারউইনবাদী’ হিটলারের অমোঘ উক্তি ছিল – ‘আপনি ভাবতেই পারেন, যে এটা ভীষণ নিষ্ঠুর পদ্ধতি, কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রকৃতির নির্বাচনে আপনি তো একেবারেই পিছিয়ে পড়া সীমাবদ্ধ একজন, সুতরাং আপনার সরে যাওয়া ছাড়া পৃথিবীর বুকে মানুষের উজ্জ্বল জয়যাত্রা সম্ভব হবে কীভাবে ?”
প্রতিভাধর-যুগান্তকারী বিজ্ঞানী ডারউইন গভীর দুঃস্বপ্নেও এই ভয়াবহ অভিযানের ছবি নিশ্চয়ই দেখতে পান নি। কিন্তু নিজস্ব যুক্তিবোধে এরকম’টা যে হতে পারে – সম্ভবত এই দুর্ভাবনায় প্রায়শই তিনি ভুগতেন। সেজন্য বিবর্তনবাদ যে দীর্ঘসময়ব্যাপী এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন যে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে নয়–অভিযোজনের মধ্য দিয়ে ঘটে, এই সহজ ফর্মুলাটি বলতে তাঁর প্রায় ২৫ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। বোধহয় ভেবেছিলেন ধর্মীয় গুরুদের হাত থেকে এই তত্ত্বকে তো বাঁচাতে হবে !
হিটলার ও তাঁর বাহিনীকে পর্যুদস্ত ক’রে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ মিত্রশক্তি শুধু পৃথিবীকে বাঁচায় নি, বাঁচিয়েছিল ডারউইনের অমোঘ বিবর্তনবাদকে’ও। আর কয়েকদিন বাদে ( ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮) ন্যূরেমবার্গে নাজিপার্টির র্যালিতে ‘ডারউইনবাদী ইউজেনিক্স সমাজবিজ্ঞান’-এর প্রথম পেশ-করা দলিলের ৮৫ বছর হতে চলেছে। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে অনেকেই।
হিটলার ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়েছে মানুষের দুর্মর প্রতিরোধে। ৭৪ বছর পরে আশ্চর্যজনকভাবে পৃথিবীজুড়ে এখন বহু ‘নেতা’ ফের সেই সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে নতুন ক’রে হাজির হচ্ছে। কারোর কাছে কেউ ‘ভয়াবহ অনুপ্রবেশকারী’, কেউ’বা ‘পিছিয়ে-পড়া বিষাক্ত উদ্বাস্তু’, কখনও কেউ ‘বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির মতই বিপজ্জনক সংক্রমণকারী’, কেউ’বা আবার ‘আল্লা-ভগবান-ঈশ্বরের বেদম শত্রু!’ আবার আমাদের দেশে হঠাৎই ‘হিন্দু জিন-র ইঞ্জেকশানে বেদ-বেদান্ত’ও ক্রমশ হয়ে উঠছে যেন চলমান বৈজ্ঞানিক এনসাইক্লোপিডিইয়া’, কখনও বা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে লটকে রাখা চোঙা থেকে ধেয়ে আসতে থাকে “তোরা উন্নয়নবিরোধী মানুষ – ক্ষয়িষ্ণু মতবাদের কয়েকটা কঙ্কাল!” ফ্যাসিস্তরা ঠিক যেভাবে ‘দেশ–মাটি-পিতৃত্ব’-র শ্লোগান তুলত, আজকে আমাদের দেশেও প্রায় একই রকম চিৎকার যেন আমাদের সাথে দেওয়ালের দূরত্ব ক্রমশ কমিয়ে আনছে । অপেক্ষায় কি আবার সেই দুর্মর প্রতিরোধের ? ডারউইনের স্বার্থে !