শনির উপগ্রহে জীবনের ইঙ্গিত

শনির উপগ্রহে জীবনের ইঙ্গিত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ই এস এ) এবং নাসার ক্যাসিনি মহাকাশযানের পুরনো তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি শনির বরফাচ্ছাদিত উপগ্রহ এনসেলাডাসে জীবনের সম্ভাবনা সম্পর্কে চমকপ্রদ ইঙ্গিত পেয়েছেন। ২০০৫ সালে ক্যাসিনি প্রথম আবিষ্কার করেছিল যে এনসেলাডাসের বরফের নীচে লুকিয়ে আছে এক বিশাল গভীর সমুদ্র। এবং এর দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি ফাটল থেকে জলের বিশাল ফোয়ারা বেরিয়ে আসে,যা বরফ কণায় রূপান্তরিত হয়ে মহাকাশে ছিটকে যায়। এই বরফের কণাগুলো শুধুই জমাট বাঁধা তরল নয়। এর ভেতরে আছে এমন কিছু জৈব অণু, যা জীবনের সূচনাকারী মূল উপাদান হতে পারে। কিছু কণা আবার শনির চারপাশে এক মিহি আংটির মতো ঘুরছে—এটাই শনির বিখ্যাত “ ই-রিং ”।

বিজ্ঞানীরা নতুন করে বিশ্লেষণ করেছেন ২০০৮ সালের ক্যাসিনির এক বিশেষ উড়ান থেকে পাওয়া তথ্য,যখন মহাকাশযানটি সরাসরি এনসেলাডাসের বরফের ফোয়ারার ভেতর দিয়ে গিয়েছিল। তখন সদ্য নির্গত বরফকণাগুলো সেকেন্ডে প্রায় ১৮কিমি গতিতে ক্যাসিনির মহাজাগতিক ধূলিকণা বিশ্লেষক যন্ত্রে আঘাত করেছিল। এত দ্রুত গতির ধাক্কায় বরফ ভেঙে গিয়ে জলের অণুগুলো আলাদা হয়ে যায়।

এই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পূর্বে শনির ই-রিং থেকে পাওয়া কিছু জৈব অণু এনসেলাডাসের নতুন বরফকণাতেও উপস্থিত। অর্থাৎ, এগুলো আসলে উপগ্রহের অভ্যন্তরস্থ মহাসাগর থেকেই উৎপন্ন। আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো বিজ্ঞানীরা এমন কিছু নতুন যৌগও শনাক্ত করেছেন যা আগে কখনও দেখা যায়নি। যার মধ্যে রয়েছে অ্যালিফ্যাটিক ইস্টার, ইথার এবং নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন যৌগ, যেগুলো পৃথিবীতে জীবনের মৌলিক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গবেষক নোজাইর খোয়াজা বলেন,তাঁরা যে জৈব অণুগুলো পেয়েছেন , সেগুলো থেকেই জীবনের প্রাথমিক গঠন শুরু হতে পারে। এ এক বিশাল সম্ভাবনার ইঙ্গিত। সহলেখক ফ্রাঙ্ক পোস্টবার্গ আরও বলেন , এই যৌগগুলো মহাকাশের বিকিরণ বা সূর্যালোকের প্রভাবে তৈরি হয়নি; এগুলো সরাসরি উপগ্রহের অভ্যন্তরে গঠিত হচ্ছে। অর্থাৎ, এনসেলাডাসের মহাসাগরে এমন জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া চলছে।

ই এস এ ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা করছে এক দুঃসাহসিক নতুন মিশনের। তাতে মহাকাশযানটি সরাসরি এনসেলাডাসের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে, বরফ ও তরল জল সংগ্রহ করবে এবং সেখানেই জীবনের অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজবে।

বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস,এনসেলাডাসে জীবনের উপযোগী সব উপাদানই উপস্থিত, যেমন- তরল জল, শক্তির উৎস, রাসায়নিক উপাদান ও জটিল জৈব যৌগ ইত্যাদি।এমনকি যদি সেখানে জীবনের কোনো চিহ্ন না-ও মেলে, তবুও সে এক মস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হবে। কারণ তখন প্রশ্ন উঠবে জীবনের উপযোগী প্রায় সব শর্তই যখন উপস্থিত তবে কেন জীবন জন্ম নেয় না সেখানে ?

এনসেলাডাস আজ শুধুই এক বরফে ঢাকা একটা উপগ্রহই নয়, এ যেন মহাবিশ্বের অজানা জীবনের রহস্যভেদী দরজা। হয়তো এই ক্ষুদ্র উপগ্রহই একদিন প্রমাণ করবে, মহাবিশ্বে ধরিত্রী মায়ের মতো তার জঠরেও প্রাণের বীজ রোপিত আছে।

 

সূত্র: “Detection of organic compounds in freshly ejected ice grains from Enceladus’s ocean” by Nozair Khawaja, Frank Postberg,et.al; (1.10.2025), Nature Astronomy.

DOI: 10.1038/s41550-025-02655-y

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − twelve =