শনির উপগ্রহে সুপ্ত তাপের সন্ধান

শনির উপগ্রহে সুপ্ত তাপের সন্ধান

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

সম্প্রতি নাসা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে শনির বরফে ঢাকা উপগ্রহ এনসেলাডাস থেকে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। দেখা গেছে, উপগ্রহটির উত্তর ও দক্ষিণ উভয় মেরু থেকেই তাপ নির্গত হচ্ছে।এযাবৎ বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, তাপ ও ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপ কেবল দক্ষিণ মেরুতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই নতুন ফলাফল প্রমাণ করেছে, এনসেলাডাসের অভ্যন্তরে একটি স্থিতিশীল, তরল ভূগর্ভস্থ সমুদ্র রয়েছে,আর সেখানেই লুকিয়ে আছে তাপের রহস্য এবং সম্ভবত সেটি জীবনের উপযোগী পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম।

সায়েন্স অ্যাডভান্সেস পত্রিকায় প্রকাশিত এই গবেষণা অনুযায়ী, এনসেলাডাসের উত্তর মেরুতেও শক্তিশালী তাপ প্রবাহ শনাক্ত হয়েছে। এতদিন বিজ্ঞানীরা বলতেন , দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের ফাটল থেকেই নাকি শুধুমাত্র তাপ ও জলীয় বাষ্প বের হয়। কিন্তু নতুন তথ্য অনুযায়ী, পুরো উপগ্রহ জুড়েই অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহ বজায় আছে। এনসেলাডাস যে একটি প্রাণহীন বরফাচ্ছাদিত উপগ্রহই নয়, বরং অত্যন্ত সক্রিয় একটি জৈব সম্ভাবনাময় জগৎ এতে বিদ্যমান এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এনসেলাডাসের বরফস্তরের নীচে একটি লবণাক্ত জলের সমুদ্র রয়েছে, যেখানে ফসফরাস ও জৈব যৌগের মতো উপাদান মজুত আছে। তরল জল, তাপ এবং রাসায়নিক উপাদান—এই তিনটিই জীবনের মৌলিক শর্ত। তাই এনসেলাডাসকে বর্তমানে সৌরজগতের অভ্যন্তরে জীবনের অনুসন্ধানের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থানগুলির একটি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

তবে এই সমুদ্রকে তরল রাখতে হলে উষ্ণতা ও শীতলতার মধ্যে ভারসাম্য থাকা জরুরি। এখন প্রশ্ন হল এই যে তাপ নির্গত হচ্ছে তার উৎসটা আসলে কোথায়? এখানেই গবেষকরা তাদের গবেষণার চমকটা তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলছেন এনসেলাডাসের ভেতরে জোয়ারভাটার আকর্ষনজনিত প্রক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ, শনির মহাকর্ষীয় শক্তি উপগ্রহটিকে ক্রমাগত টানাপোড়েনে ফেলছে ,যার ফলে অভ্যন্তরে ঘর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং তাপ উৎপন্ন হয়। আর এই তাপই বরফের নীচের সমুদ্রকে তরল অবস্থায় রাখতে সাহায্য করে।

নাসার ক্যাসিনি মহাকাশযান ২০০৫ এবং ২০১৫ সালের মধ্যে এনসেলাডাসের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করে। গবেষকরা দেখেন, উত্তর মেরুর পৃষ্ঠ প্রত্যাশিত তাপমাত্রার তুলনায় প্রায় ৭ কেলভিন বেশি উষ্ণ। এই অতিরিক্ত তাপ কেবল ভূগর্ভস্থ সমুদ্র থেকে আসা তাপপ্রবাহের ফল বলেই ধরা যায়।

তাপ প্রবাহের হিসাব অনুযায়ী, এনসেলাডাস থেকে মোট প্রায় ৫৪ গিগাওয়াট তাপ শক্তি নির্গত হচ্ছে। এটি পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ সৌর প্যানেল বা হাজার হাজার বায়ুচালিত টারবাইনের শক্তির সমান। এই পরিমাণ তাপ প্রমাণ করে, উপগ্রহটির অভ্যন্তরীণ শক্তির ভারসাম্য রয়েছে এবং এটি কোটি কোটি বছর ধরে স্থিতিশীল থাকতে পারে। এর মানে, জীবনের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কার্লি হাওয়েট বলেন, এনসেলাডাসের শক্তি ভারসাম্য ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এটিকে জীবনের সম্ভাব্য ধারক হিসেবে তুলে ধরছে।

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যদি এই তাপপ্রবাহ দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত থাকে, তবে উপগ্রহটির ভূগর্ভস্থ সমুদ্র কোটি কোটি বছর তরল থাকতে পারে, যা জীবনের বিকাশের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে।

তাপমাত্রার তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বরফস্তর কতটা পুরু তাও অনুমান করেছেন। এনসেলাডাসের বরফস্তর উত্তর মেরুতে প্রায় ২০ থেকে ২৩ কিলোমিটার পুরু, এবং গড়ে ২৫ থেকে ২৮ কিলোমিটার পুরু। এই তথ্য ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশনগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো বরফ ভেদ করে ভূগর্ভস্থ সমুদ্রে প্রবেশ ও নমুনা সংগ্রহের পরিকল্পনায় সাহায্য করবে।

ড. জর্জিনা মাইলস বলেছেন, এনসেলাডাসের শক্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রাপ্যতা বোঝা মানেই জীবনের সম্ভাবনা বোঝা।

গবেষকদের আশা, এই ক্ষুদ্র বরফাচ্ছন্ন জগত হয়তো একদিন ভিনগ্রহের জীবনের প্রথম প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে।

 

সূত্র: “Endogenic heat at Enceladus’ north pole” by Georgina Miles, Carly J. A. Howett,et.al; 7th November 2025, Science Advances.

DOI: 10.1126/sciadv.adx4338

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 1 =