শুক্রাণুর ল্যাজ-নাড়া ও চিতাবাঘের গায়ের দাগ

শুক্রাণুর ল্যাজ-নাড়া ও চিতাবাঘের গায়ের দাগ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ জুলাই, ২০২৫

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুপ্ত সংকেতের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করার জন্য প্রসিদ্ধ অ্যালান টুরিং প্যাটার্ন গঠনের একটি তত্ত্বও তৈরি করেছিলেন। প্রতিক্রিয়া-প্রসারণ তত্ত্ব নামে অভিহিত (Reaction-Diffusion Theory) এই তত্ত্ব এই পূর্বাভাস দিয়েছিল যে রাসায়নিক প্যাটার্নগুলি মাত্র দুটি উপাদানের সাথেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবির্ভূত হতে পারে। রাসায়নিকগুলি ছড়িয়ে পড়ে এবং একসাথে বিক্রিয়া করে আর তা থেকেই প্যাটার্ন তৈরি হয়। এর পরীক্ষামূলক প্রমাণ এতদিনে মিলল। নেচার কমিউনিকেশনস -এ প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, শুক্রাণুর ল্যাজ-নাড়া, সিলিয়ার সরু সরু চুল জাতীয় কাঠামো কিংবা ফ্ল্যাজেলা নামক চাবুকের ডগার মতো সরু উপাঙ্গর চলাচল অ্যালান টুরিং আবিষ্কৃত প্যাটার্ন গঠনের ওই ধরণকেই অনুসরণ করে। এই অস্থিরতা থেকে উৎপন্ন তরঙ্গ লেজ বরাবর চালিত হয়ে শুক্রাণু এবং জীবাণুগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

পলিম্যাথস ল্যাবের প্রধান গণিতবিদ ডঃ হার্মিস গ্যাডেলহা এবং তাঁর পিএইচডি ছাত্র জেমস ক্যাস ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যাথমেটিক্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। কম সান্দ্রতাযুক্ত তরলের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা উৎসাহিত হয়ে গবেষকদলটি দেখেন, চাবুকের সরু ডগার মতো উপাঙ্গগুলির (ফ্ল্যাজেলা) উপর পরিপার্শ্বর ভূমিকা গৌণ। গাণিতিক মডেলিং, সিমুলেশন এবং ডেটা ফিটিং ব্যবহার করে দেখা যায়, এই উপাঙ্গগুলির অস্থিরতা তাদের তরল পরিপার্শ্বর প্রভাব ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখা দিতে পারে। শুক্রাণুর সাঁতারের ক্ষেত্রে, আণবিক মোটরের রাসায়নিক বিক্রিয়া ফ্ল্যাজেলা উপাঙ্গটিকে শক্তি জোগায় এবং বক্রগতি লেজ বরাবর তরঙ্গের আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকে বোঝা যায়, অত্যন্ত জটিল গতি অর্জনের জন্য কেবল দুটি সহজ উপাদানের প্রয়োজন। ডঃ গ্যাডেলহা বলেছেন, “ফ্ল্যাজেলাম নামক উপাঙ্গটি আশেপাশের তরল দ্বারা প্রভাবিত না হলেও তা থেকে ভ্রমণ তরঙ্গ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে। এর অর্থ হল, কম সান্দ্রতাযুক্ত পরিবেশে সাঁতার কাটার জন্য ফ্ল্যাজেলামের একটি নির্ভুল প্রক্রিয়া রয়েছে, যা অন্যথায় জলজ প্রজাতির পক্ষে অসম্ভব হত। এই প্রথম মডেলের সিমুলেশনগুলিকে পরীক্ষামূলক তথ্যের সাথে ভালভাবে তুলনা করে দেখা হল ।” গবেষকরা নড়াচড়ার ধরণ তৈরির জন্য একটি সহজ গাণিতিক মডেল আবিষ্কার করেছেন। এর সাহায্যে রোবোটিক প্রয়োগ, কৃত্রিম পেশী এবং অ্যানিমেটেড উপকরণের জন্য আরও অন্বেষণ চালানো যাবে।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, স্থানে ও কালে ফ্ল্যাজেলার এই অস্থিরতাই তৈরি করে ডোরাকাটা প্যাটার্ন, যা আমরা দেখি চিতাবাঘের গায়ের দাগে, সূর্যমুখীর মাথায় বীজের ঘূর্ণিতে বা সাগরসৈকতে বালিতে। চোখে-দেখা প্যাটার্ন এবং নড়াচড়ার প্যাটার্নগুলির মধ্যে এই অভিন্নতার বিষয়টি আকর্ষণীয় এবং অপ্রত্যাশিত। ডঃ গ্যাডেলহা ব্রিস্টল রোবোটিক্স ল্যাবরেটরির সফটল্যাবেরও একজন সদস্য। সেখানে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের সফট রোবট উদ্ভাবনের প্যাটার্ন গঠনের গণিত প্রয়োগ করেন। তাঁর কথায়, “আমাদের এই প্রতিক্রিয়া-প্রসারণ মডেলটি সমস্ত জটিলতাকে সম্পূর্ণরূপে বোঝার অনেক সহজ উপায়। সংকেত উদ্ধারের গাণিতিক পদ্ধতিকেও তা কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।”

সূত্র : “The reaction-diffusion basis of animated patterns in eukaryotic flagella” by James Cass and Dr. Hermes Bloomfield-Gadêlha, 27 September 2023 Nature Communications.
DOI: 10.1038/s41467-023-41405-4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × three =