বিশ্বব্যাপী সমাজ আজ বিভাজনের সংকটে। রাজনীতি, মতাদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে মানুষ পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই সামাজিক মেরুকরণের পেছনে আসলে কী কারণ কাজ করছে, তা খুঁজে বের করেছেন অস্ট্রিয়ার কমপ্লেক্সিটি সায়েন্স হাব -এর একদল বিজ্ঞানী। তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে এক আশ্চর্য দ্বন্দ্বমূলক সত্য। তাঁরা বলেন মানুষ যত বেশি সংযুক্ত হচ্ছে, সমাজ তত বেশি বিভক্ত হয়ে পড়ছে।
গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বিজ্ঞান সাময়িকী প্রসিডিংস অফ দ্যা ন্যাশনাল একাডেমী অফ সায়েন্সেস (পি এন এ এস)-এ। সেখানে দেখা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মানুষের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা গড়ে দুই থেকে বেড়ে দাঁড়ায় চার থেকে পাঁচজনে। অথচ, একই সময়ে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়।
গবেষক স্টেফান থুরনার ব্যাখ্যা করেছেন, এই পরিবর্তনের সূচনা মূলত সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসার ও স্মার্টফোন ব্যবহারের বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর মতে, যখন মানুষ সামাজিকভাবে আরও সংযুক্ত হয়, তখন তারা নানা মত ও চিন্তার আরও ঘন ঘন মুখোমুখি হয় এবং নিজের স্বাধীন মতামতও প্রকাশ করতে থাকে। এর ফলে মতবিরোধ বাড়ে, গোষ্ঠীগত সংঘাত সৃষ্টি হয়, এবং সমাজ ক্রমে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
গবেষণার সহ-লেখক ইয়ান কোরবেল এই ঘটনা বোঝাতে গণিতভিত্তিক সামাজিক মডেল ব্যবহার করেন। দেখা যায়, অতীতে মানুষ সাধারণত দুইজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ওপর নির্ভর করত, যারা ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলত। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে এই সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। এ মডেল অনুযায়ী সমাজ মাধ্যমগুলোর রমরমা হলে সমাজে মেরুকরণও হঠাৎ বৃদ্ধি পায়। এ যেন পদার্থবিজ্ঞানের দশা পরিবর্তনের মতো – যেমন জল হঠাৎ বরফে পরিণত হয়। গবেষকদের মতে, এই সঙ্কটসীমা সম্ভবত তিন থেকে চারটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে কোথাও অবস্থান করছে।
গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ৫৭,০০০-এরও বেশি মানুষের উপর বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন, ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত রাজনৈতিক মতামতের পরিবর্তন পরিমাপ করেছেন। তাতে দেখা গেছে, একসময় যেখানে মাত্র ১৪% মানুষ ধারাবাহিকভাবে উদারপন্থী মত পোষণ করত, ২০১৭-তে সেই হার বেড়ে ৩১%-এ পৌঁছায়। একইভাবে, রক্ষণশীল ধারার অনুগামীও দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি স্পষ্টভাবে কোনো একটি পক্ষের সঙ্গে নিজেদের মেলাচ্ছে—মিশ্র মতধারার মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
থুরনার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, যখন কারও মাত্র দুইজন বন্ধু থাকে, সে সম্পর্ক রক্ষায় বেশি সহনশীল হয়। কিন্তু যখন পাঁচজন বন্ধু থাকে, তখন কোনো একজনের সঙ্গে বিরোধ হলে সেই সম্পর্ক সহজেই ভেঙে যায়। এই মানসিক পরিবর্তনের ফলে সহনশীলতার সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি।
বিজ্ঞানীদের মতে ২০০৮ সালের পর স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান মানুষের সংযোগের ধরন পাল্টে দিয়েছে—আর সেই সংযোগই বিচ্ছেদের জন্ম দিচ্ছে। সমাজ যেন এখন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে আটকে, সংযোগ যত বাড়ছে, দূরত্বও তত বাড়ছে।
থুরনার -এর মতে গণতন্ত্রে টিকে থাকতে হলে সমাজের প্রতিটি অংশের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ থাকা দরকার। ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতা ও পরস্পরকে বোঝার ক্ষমতাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন এই প্রবণতা রোধ করতে হলে শৈশব থেকেই শিখতে হবে ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতা ও আলোচনার সংস্কৃতি। তাহলে হয়তো আমরা আবার একে অপরের কাছাকাছি ফিরতে পারব।
সূত্র: “Why more social interactions lead to more polarization in societies” by Stefan Thurner, Markus Hofer and Jan Korbel, 31st October 2025, Proceedings of the National Academy of Sciences.
DOI: 10.1073/pnas.2517530122
