
নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে এমন এক বিস্ময়কর তথ্য, যা লিঙ্গ এবং আচরণবিজ্ঞানের ধারণাকে বেশ চমকে দেয়। ধরুন একটা মাছ একটা দলে আছে। সেই দলের নেতা সরে গেল। হঠাৎ-ই সেই মাছ অনুভব করল, শরীরের ভিতরের কিছু বদল- মন বদলাচ্ছে, আচরণ বদলাচ্ছে, এমনকি লিঙ্গও বদলে যাচ্ছে। এ কোনো কল্পবিজ্ঞান গল্প নয়, এ হল নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রে বসবাসকারী এক অদ্ভুত মাছের বাস্তব জীবন। ‘পাকেতি’ নামের এই মাছ ( যার অন্য নাম স্পটি) পরিস্থিতির চাপে নিজের লিঙ্গ বদলাতে পারে। আর বদলে যায় মস্তিষ্ক। কিন্তু জিনের পরিবর্তন নয়, এ হল খাঁটি সামাজিক প্রতিক্রিয়া। শারীরবিদ্যাবিদ হেইলি কুয়েরটারমাস এবং তার সহযোগীরা এই গবেষণাটি করেছেন। এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে রয়্যাল সোসাইটি বি জার্নালে। তাঁরা দেখেন, যখন একটি দলের সর্দার পুরুষ মাছটিকে সরিয়ে ফেলা হয় বা তার মৃত্যু ঘটে, ঠিক তখনই কয়েক মিনিটের মধ্যেই দ্বিতীয় স্থানে থাকা মাছটি আক্রমণাত্মক আচরণ দেখাতে শুরু করে। এ এক স্পষ্ট মানসিক ও জৈবিক পালাবদলের সূচনা। হেইলি বলেন, “আমি ভাবিনি মাছটি এত দ্রুত আচরণ বদলাবে। কিন্তু সত্যি বলতে, বেশিরভাগ কৃত্রিম জলাধারেই আমরা দেখেছি, সর্দার মাছটি সরে যাওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট পরেই দ্বিতীয় মাছটি নিজের আগ্রাসন প্রকাশ করছে।” এই আগ্রাসন ‘রাশ’ নামে পরিচিত। সেখানে দ্বিতীয় মাছটি অধস্তন মাছের দিকে বজ্রগতিতে ছুটে যায়। তারা একে অপরকে মোচড় দেয়, টান দেয়, পাল্টে দেয়, কখনও লেজে কখনও বা পাখনার দিকেও কামড় বসায়। আর ক্ষমতার টানেই তখন তার শরীর বদলে ফেলে নিজের রূপ। এক এক করে সে জাহির করে তার সর্দারি। শুধু তা-ই নয়, এই সামাজিক কর্তৃত্বের দখলই শুরু করে দেয় তার লিঙ্গ বদলের প্রক্রিয়া। গবেষকরা জানাচ্ছেন, ‘নারী থেকে পুরুষ’ হয়ে যাওয়ার এই বিষয়টি কিন্তু নিছকই পুরুষালি আচরণ শিখে ফেলা নয়। বরং এটি হচ্ছে ‘গঠনমূলক সামাজিক জায়গা দখলের সাথে মস্তিষ্কের পুনর্গঠন’। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ‘ক্লাউনফিশ’ প্রজাতিতে এর ঠিক উল্টোটি ঘটে। তারা পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠে এবং নারীপ্রধান দলে জায়গা খালি থাকলে, সেই শূন্যস্থান পূরণে আগ্রহী হয়। পাকেতি মাছের দলতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ‘আকারভিত্তিক’। বড় মাছ ছোটদের উপর কর্তৃত্ব ফলায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সুযোগ পেলেই বড় মাছই প্রথমে লিঙ্গ পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হয়। এই গবেষণার অন্যতম দিক ছিল, মস্তিষ্কের স্নায়বিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ। স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. কাজ কামস্ত্রা জানিয়েছেন, এই মাছেদের মস্তিষ্কে থাকা ‘সামাজিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণ’ অংশটি অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করে, যখন কোনো মাছ সামাজিক শ্রেণিতে উপরের দিকে ওঠে। এই সংযোগ জাল অন্য পদে থাকা মাছদের তুলনায় প্রভাবশালী মাছদের মধ্যে ভিন্নভাবে কাজ করে। কামস্ত্রা বলেন, “এ থেকে বোঝা যায়, সামাজিক পরিবর্তন শুধু আচরণ নয়, মস্তিষ্কের ভিতরের প্রক্রিয়াকেও বদলে ফেলে। আর সেটাই নিশ্চিত করে কে নেতা হবে এবং লিঙ্গ পাল্টাবে”। এই গবেষণার তাৎপর্য শুধু সমুদ্রসীমায় আটকে নেই। মৎস্য পালন ও বাণিজ্যিক মাছ চাষেও এর মূল্য অপরিসীম। বিশেষত নিউজিল্যান্ডের ব্লু-কডের মতো যেসব প্রজাতি লিঙ্গ পরিবর্তন করে থাকে সেই মাছ চাষের ক্ষেত্রে। তবে জীবনের থিয়েটারে, সিংহাসনের লোভে লিঙ্গ ছেড়ে আরেক লিঙ্গে প্রবেশ, যেন প্রকৃতির ‘গেম অফ থ্রোনস’।