কেউ হঠাৎ আঘাত পেলে আমরা প্রায়শই অজান্তেই কেঁপে উঠি। কারও চোখে জল দেখলে আমাদের বুক ভারী হয়ে আসে। এই প্রতিক্রিয়াগুলো কেবল আবেগী সহানুভূতি নয়, আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, এগুলো মস্তিষ্কের গভীরে ঘটে যাওয়া বাস্তব শারীরিক প্রক্রিয়ার ফল।
নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট ফর নিউরোসায়েন্সের নেতৃত্বে পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, মানুষের মস্তিষ্কের ভিজুয়াল কর্টেক্সে (দৃষ্টিকেন্দ্র) শরীরের মতো সাজানো আটটি স্বতন্ত্র মানচিত্র রয়েছে। এই মানচিত্রগুলো চোখে-দেখা দৃশ্যকে সংগঠিত করে, ঠিক যেমন মস্তিষ্ক স্পর্শ অনুভূতিকে সাজিয়ে রাখে। ফলে আমরা যখন অন্য কাউকে দেখি, সেই দৃশ্য আংশিকভাবে নিজের শরীরের অনুভূতির মতো করেই মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়।
এই গবেষণার বিশেষত্ব হলো এর পদ্ধতি। নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার পরিবর্তে অংশগ্রহণকারীদের এমআরআই স্ক্যানারের ভেতরে রেখে হলিউড চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখানো হয়। স্বাভাবিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যেই বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন—দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মস্তিষ্কের সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স, অর্থাৎ স্পর্শ-নিয়ন্ত্রক অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই কারণেই কারও আঘাত দেখলে আমাদের নিজের শরীরেও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার হলো, দৃষ্টিকেন্দ্রে পাওয়া এই মানচিত্রগুলোও মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাজানো—একেবারে স্পর্শের মানচিত্রের মতো। এর মানে, দেখাকে মস্তিষ্ক কেবল দৃশ্য হিসেবে গ্রহণ করে না; বরং সেটিকে শরীরকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে। এখান থেকেই জন্ম নেয় সহমর্মিতা – অন্যের যন্ত্রণা, ভঙ্গি বা আবেগকে নিজের ভেতরে অনুভব করার ক্ষমতা।
গবেষকেরা মনে করেন, একাধিক মানচিত্র থাকাটা কোনো অপ্রয়োজনীয় জটিলতা নয়। বরং এটি মস্তিষ্ককে একই সঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য বিশ্লেষণের সুযোগ দেয়। কোন মানচিত্রটি সক্রিয় হবে, তা নির্ভর করে আমরা কী লক্ষ্য করছি তার ওপর । কখনো আমরা কারও হাতের নড়াচড়ায় মন দিই, কখনো তার মুখভঙ্গি বা দেহভঙ্গিমায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্ন মানচিত্র সক্রিয় হয়ে আমাদের বোঝার ক্ষমতাকে তীক্ষ্ণ করে।
এই আবিষ্কারের প্রভাব শুধু তাত্ত্বিক নয়। এটি অটিজমসহ বিভিন্ন সামাজিক ও স্নায়বিক সমস্যার চিকিৎসা, ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস, এমনকি মানবসদৃশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের নতুন পথ খুলে দিতে পারে। গবেষকদের ভাষায়, মানব অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে যে শারীরিক অনুভূতি জড়িয়ে আছে—এই আবিষ্কার সেই গভীর সত্যের পরিচয়বাহী। সহমর্মিতা কোনো বিমূর্ত অনুভূতি নয়, এটি এক ধরনের শারীরিকভাবে অনুভূত মানবিক বন্ধন।
সূত্র: Hidden brain maps that make empathy feel physical by Netherlands Institute for Neuroscience – KNAW, 23rd December 2025.
