সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ জনিত উদ্বেগ

সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ জনিত উদ্বেগ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৭ মার্চ, ২০২৫

সমুদ্রে যে নিয়মিত তাপপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে তা ক্রমবর্ধমান সমুদ্র-তাপমাত্রারই উপজাতক। আগে সমুদ্রের তাপপ্রবাহ এতো নিয়মিত হত না। উপরন্তু এগুলি হতো স্বল্পস্থায়ী। কিন্তু বর্তমানে এগুলি আরও ঘন ঘন এবং দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। মেরিন বায়োলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য ইউনাইটেড কিংডম এবং বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এটিকে ‘গুরুতর সমস্যা’ হিসাবে চিহ্নিত করে সতর্ক করছেন। সমুদ্রের এই বাড়তি তাপমাত্রা সমুদ্রজীবনের জন্য ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, পারিবেশিক ব্যবস্থাকেও এটি ঝুঁকিতে ফেলছে, আবহাওয়ার প্রবাহকে ব্যাহত করছে এবং তটবর্তী জীব সম্প্রদায়গুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে – আগের চেয়ে অনেক বেশি।
প্রাথমিকভাবে, এটিকে তাপমাত্রার সাময়িক বৃদ্ধি কিংবা স্থানীয় অস্বাভাবিকতা বলে মনে করা হত। তবে, পরিসংখ্যানগত প্রমাণ একটি আলাদা গল্প বলছে। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের মধ্যে সমুদ্রের তাপপ্রবাহের ঘটনা পূর্ববর্তী রেকর্ডগুলির চেয়ে ২৪০শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধিহার অত্যন্ত তীব্র। দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহগুলি, পারিবেশিক ব্যবস্থার পুনরুত্থানের পথে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি করছে। যেমন, প্রবাল প্রাচীরগুলি ফ্যাকাসে বা সাদাটে হয়ে যাওয়া, শৈবাল-বনগুলি বিলীন হওয়া, এবং সামুদ্রিক খাদ্য শৃঙ্খলগুলি ভেঙে পরা। সুতরাং এগুলি কোনো তাৎক্ষণিক ক্ষতি নয় বরং দীর্ঘমেয়াদী অপরিবর্তনীয় ক্ষতির উদ্বেগ বয়ে আনছে।

এখন প্রশ্ন হলো কেন এমনটা হচ্ছে। সমুদ্র থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত গরম তাপের প্রভাব শুধুমাত্র সামুদ্রিক পরিবেশে সীমাবদ্ধ থাকে না। ফলত, তাপ আরও তীব্রতর ঝড়ের সূচনা করে। যেমনটি ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ডে, সাইক্লোন গ্যাব্রিয়েলে দেখা গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে সমুদ্রজীবনও জীবন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। বহু সামুদ্রিক জীব যেমন, তিমি, ডলফিন খাবারের সন্ধানে তীরের কাছাকাছি যেতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকসময়ই এরা আটকে পড়ে মারা যায়। অন্যদিকে কিছু ঝিনুক প্রজাতি অত্যধিক গরম জলে আটকে গিয়ে লক্ষাধিক সংখ্যায় মরে যায়। ফলে পুরো খাদ্যশৃঙ্খলই ভেঙে পড়ছে। প্রবাল প্রাচীরগুলি সমুদ্রের প্রত্যেকটি তাপপ্রবাহের চাপ বহন করে। সাদা, ফ্যাকাসে বা বিবর্ণ প্রবাল শুধুমাত্র দেখতেই খারাপ নয়, বরং এটি প্রবালের মৃত্যুর সংকেত বহন করে। প্রবালের ক্ষয় , প্রবাল নির্ভর সামুদ্রিকজীব সম্প্রদায়গুলিকেও বিপর্যস্ত করে তোলে। সেক্ষেত্রে জৈব বৈচিত্র্য হ্রাস পায়। বিজ্ঞানীরা এই প্রবাল প্রাচীরগুলির দুর্দশার ওপর নজর রাখলেও এই পরিমাণ ক্ষতি তাদের অবাক করছে। একবার প্রবাল ধ্বংস হলে, তার পুনরুদ্ধারে দশক কেটে যেতে পারে- যদি আদৌ পুনরুত্থান সম্ভব হয়! সংরক্ষণে নিয়োজিত দলগুলি, বিপন্ন প্রজাতিগুলিকে সুরক্ষা দিতে, ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাল পুনরুদ্ধার করতে এবং সামুদ্রিক অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে নিরন্তর কাজ করছেন। তবে আসল সমস্যাটি বায়ুমণ্ডলে নিহিত। বাড়তি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ তাপকে আটকে রাখে। তাপমাত্রা কমানো এবং সমুদ্রকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেওয়ার জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে। এক্ষেত্রে তাত্ত্বিক সমাধান থাকলেও, তা বাস্তবায়ন করা একটি দুরূহ কাজ। এই ক্ষতি শুধুমাত্র সমুদ্রগহনেই সীমাবদ্ধ নয়। তটবর্তী জীব সম্প্রদায়গুলি, বিশেষ করে মৎস্য ও পর্যটন নির্ভর সম্প্রদায়গুলি, এর প্রভাব অনুভব করছে ইতিমধ্যেই। গরম জল মাছের সংখ্যা কমাচ্ছে। ফলত, মাছ ব্যবসা সংকটের পথে। প্রবাল প্রাচীর ঘিরে পর্যটন কমে যাচ্ছে। শক্তিশালী ঝড় এবং ঘন ঘন বন্যা তটরেখার জনজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বর্তমানে সমুদ্রের তাপপ্রবাহগুলিকে অবহেলা করলে পরবর্তীতে ক্ষতি, মেরামত-খরচ আরও বাড়বে।আমাদের সমুদ্রের ভবিষ্যৎ ভারসাম্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আজ আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, তা নির্ধারণ করবে সামুদ্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে নাকি পল্লবিত হবে !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × four =