পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ও রহস্যময় ভূতাত্ত্বিক অঞ্চলের একটি হল সুমেরু মহাসাগরের তলদেশ। সেখানে প্রথমবারের মতো সাহসী অভিযানে নেমে চীনা বিজ্ঞানীরা খুলে দিয়েছেন নতুন বৈজ্ঞানিক দিগন্ত। গত মাসে সমাপ্ত এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে তারা পৌঁছে যান গাক্কেল রিজের (শৈলশিরার) পূর্বাংশে। এর আগে কোনো দেশের বিজ্ঞানীই এই অংশটি এত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সমুদ্রতলের আগ্নেয় শৈলশ্রেণির গঠন, সম্ভাব্য উষ্ণজলের উৎস এবং বরফের নীচের অন্ধকার জগতে লুকিয়ে থাকা প্রাণের ছাপ খোঁজা।
গাক্কেল রিজ হলো সমুদ্রতলের নীচে বিস্তৃত বিশাল আগ্নেয় পর্বতমালার বৈশ্বিক যোগসূত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে পাত সংস্থানগত ব্যবস্থার মেরুদণ্ডও বলা যায়। চীনা অভিযাত্রীরা মানবচালিত গভীর জলযান ‘ফেন্দৌঝে’ ব্যবহার করে ৫,২৭৭ মিটার গভীর পর্যন্ত ডুব দেন এবং ৪০টিরও বেশি ডুব অভিযান সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণে ধারণা মিলছে, রিজের পূর্বাংশেও রয়েছে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট—উষ্ণ, খনিজসমৃদ্ধ জলের ফোয়ারার মতো উৎস, যেগুলো সমুদ্রতল থেকে উঠে আসে। প্রাথমিক বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পূর্ব গাক্কেল রিজেও হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট বা উষ্ণজল নির্গমনের উৎস থাকতে পারে যেগুলো সমুদ্রতল থেকে উষ্ণ খনিজসমৃদ্ধ জল ছিটকে বের করে। যেমনটি বহু বছর আগে রিজের পশ্চিম অংশে পাওয়া গিয়েছিল। এই নির্গমনপথগুলোতে সূর্যালোকহীন গভীর অন্ধকারেও অদ্ভুত সব বাস্তুতন্ত্র টিকে আছে, অবিশ্বাস্যভাবে প্রানীজগৎ সেখানে বিকশিত হয়। অর্থাৎ, এখানে টিকে থাকতে সূর্যালোকের প্রয়োজন নেই, কেবল রাসায়নিক শক্তিই যথেষ্ট।
বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে এক মূল্যবান দৃষ্টান্ত। কারণ এগুলোই ইঙ্গিত দেয় যে সৌরজগতের অন্যান্য বরফাচ্ছন্ন জগতে, বিশেষত বৃহস্পতি বা শনি গ্রহের বরফ-আবৃত উপগ্রহের গভীর মহাসাগরেও কি জীবন টিকে থাকতে পারে। তাই গাক্কেল রিজ পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের পাশাপাশি মহাজাগতিক জীবনেরও এক সম্ভাব্য আশার আলো।
এই অভিযানের প্রধান বিজ্ঞানী, সানিয়ার ইনস্টিটিউট অব ডিপ-সি সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সামুদ্রিক ভূ-ভৌতবিদ শিয়াওশিয়া হুয়াং জানান, সংগৃহীত শিলা, জল ও প্রাণীর নমুনা বিশ্লেষণে কয়েক বছর লাগবে। তাঁর মতে, এই অঞ্চলটিকে নিয়ে চর্চার শেষ অঙ্গ হবে এটি—যা সুমেরু মহাসাগরের অনবদ্য গভীর-সামুদ্রিক পরিবেশের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরবে। কারণ পূর্ব গাক্কেল রিজ এতদিন কার্যত মানবচোখে অদেখাই রয়ে গিয়েছিল।
গাক্কেল রিজ গ্রিনল্যান্ডের উপকূল থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানকার আগ্নেয় উদ্গিরণে সমুদ্রতলে নতুন ভূত্বক তৈরি হলেও, বিস্তারের হার পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন – মানুষের নখ বাড়ার গতির চেয়েও ধীর। তবুও এই ধীর ভূ-প্রক্রিয়া কীভাবে পর্যাপ্ত তাপ ও রাসায়নিক শক্তি উৎপন্ন করে ভেন্ট-ব্যবস্থাকে সচল রাখে, তা এক মস্ত বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের পাশাপাশি এখনো বিস্ময় জাগায়।
২০০১ সালে মার্কিন-জার্মান যৌথ অভিযানে রিজের পশ্চিম অংশে প্রথম হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট আবিষ্কৃত হয়। পরে বহুবার সে এলাকায় অভিযান চালানো হলেও রিজের পূর্বাংশের পরিবেশ এতোটাই দুর্গম যে কোনো পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান আগে সম্ভব হয়নি। তবে রুশ বিজ্ঞানীরা কিছু সীমিত জরিপ করেছিলেন, কিন্তু এই চীনা অভিযানের মতো পূর্ণাঙ্গ ভূতাত্ত্বিক জরিপ এর আগে হয়নি।
ভাসমান বরফের ঝুঁকির কারণে এতদিন যে এলাকা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের নাগালের বাইরে ছিল, সেই অজানা জগতকে প্রথমবার এত কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখলেন চীনা গবেষকেরা। তাদের এই অভিযান শুধু সুমেরু মহাসাগরের তলদেশের অধ্যয়নেই নয়, ভবিষ্যতের অন্য গ্রহের প্রাণের অনুসন্ধানেও নতুন বৈজ্ঞানিক দিগন্তের হদিশ দিয়েছে।
সূত্র: Chinese researchers reveal unexplored section of mysterious Arctic Ocean ridge. Oceanographers hope to find otherworldly ecosystems at hydrothermal vents on the sea floor By Alexandra Witze, published in ‘nature’ journal, 12th November,2025.
doi: https://doi.org/10.1038/d41586-025-03679-0
